পল্লী-সমাজ/ষোড়শ পরিচ্ছেদ

১৬

 প্রতি বৎসর রমা ঘটা করিয়া দুর্গোৎসব করিত এবং প্রথম পূজার দিনেই গ্রামের সমস্ত চাষাভুষা প্রভৃতিকে পরিতোষ পূর্ব্বক ভোজন করাইত। ব্রাহ্মণ-বাটীতে মায়ের প্রসাদ পাইবার জন্য এমনি হুড়ামুড়ি পড়িয়া যাইত যে, রাত্রি একপ্রহর পর্য্যন্ত ভাঁড়ে-পাতায় এঁটোতে-কাঁটাতে বাড়ীতে পা ফেলিবার জায়গা থাকিত না। শুধু হিন্দু নয়, পীরপুরের প্রজারাও ভিড় করিতে ছাড়িত না। এবারও সে নিজে অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও আয়োজনের ত্রুটী করে নাই। চণ্ডীমণ্ডপে প্রতিমা ও পূজার সাজ-সরঞ্জাম। নীচে উৎসবের প্রশস্ত প্রাঙ্গণ। সপ্তমীপূজা যথাসময়ে সমাধা হইয়া গিয়াছে। ক্রমে মধ্যাহ্ন অপরাহ্নে গড়াইয়া, তাহাও শেষ হইতে বসিয়াছে। আকাশে সপ্তমীর খণ্ড-চন্দ্র পরিস্ফুট হইয়া উঠিতে লাগিল; কিন্তু মুখুয্যে-বাড়ীর মস্ত উঠান জনকয়েক ভদ্রলোক ব্যতীত একেবারে শূন্য, খাঁ খাঁ করিতেছে। বাড়ীর ভিতরে অন্নের বিরাট স্তূপ ক্রমে জমাট বাঁধিয়া কঠিন হইতে লাগিল, ব্যঞ্জনের রাশি শুকাইয়া বিবর্ণ হইয়া উঠিতে লাগিল, কিন্তু এখন পর্য্যন্ত একজন চাষাও মায়ের প্রসাদ পাইতে বাড়ীতে পা দিল না। ‘ইস্‌! এত আহার্য্য-পেয় নষ্ট করিয়া দিতেছে, দেশের ছোট লোকের দল? এত বড় স্পর্দ্ধা!' বেণী হুঁকা হাতে একবার ভিতরে, একবার বাহিরে, হাঁকাহাঁকি দাপাদাপি করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন;—“ব্যাটাদের শেখাবো—চাল কেটে তুলে দেব,—এমন ক’র্‌ব, তেমন ক’র্‌ব ইত্যাদি।” গোবিন্দ, ধর্ম্মদাস, হালদার প্রভৃতি এঁরা রুষ্টমুখে অবিশ্রান্ত ঘুরিয়া ঘুরিয়া আন্দাজ করিতে লাগিলেন, কোন্‌ শালার কারসাজিতে এই কাণ্ডটা ঘটিয়াছে! হিন্দু মুসলমান একমত হইয়াছে, এও ত বড় আশ্চর্য্য! এদিকে অন্দরে মাসী ত একেবারে দুর্ব্বার হইয়া উঠিয়াছেন। সেও এক মহামারী ব্যাপার! এই তুমুল হাঙ্গামার মধ্যে শুধু একজন নীরব হইয়া আছে—সে নিজে রমা। একটি কথাও সে কাহারো বিরুদ্ধে কহে নাই,—কাহাকেও দোষ দেয় নাই,—একটা আক্ষেপ বা অভিযোগের কণামাত্র বাক্যও এখন পর্য্যন্ত তাহার মুখ দিয়া বাহির হয় নাই। এ কি সেই রমা? সে যে অতিশয় পীড়িত, তাহাতে লেশমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু সে নিজে স্বীকার করে না,—হাসিয়া উড়াইয়া দেয়। রোগে রূপ নষ্ট করে—সে যাক্‌। কিন্তু, সে অভিমান নাই, সে রাগ নাই—সে জিদ নাই। ম্লান চোখ-দুটি যেন ব্যথায় ও করুণায় ভরা। একটু লক্ষ্য করিলে মনে হয়, যেন ঐ দুটি সজল আবরণের নীচে রোদনের সমুদ্র চাপা দেওয়া আছে—মুক্তি পাইলে বিশ্বসংসার ভাসাইয়া দিতে পারে। চণ্ডীমণ্ডপের ভিতরের দ্বার দিয়া রমা প্রতিমার পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহাকে দেখিবামাত্র শুভানুধ্যায়ীর দল একেবারে তার-স্বরে ছোটলোকদের চোদ্দপুরুষের নাম ধরিয়া গালিগালাজ করিতে লাগিল। রমা শুনিয়া নিঃশব্দে একটুখানি হাসিল। বোঁটা হইতে টানিয়া ছিঁড়িলে মানুষের হাতের মধ্যে ফুল যেমন করিয়া হাসে—ঠিক তেম্‌নি। তাহাতে রাগ-দ্বেষ, আশা-নিরাশা, ভাল-মন্দ কিছুই প্রকাশ পাইল না। সে হাসি সার্থক কি নিরর্থক, তাহাই বা কে জানে!

 বেণী রাগিয়া কহিল,—“না না, এ হাসির কথা নয়, এ বড় সর্ব্বনেশে কথা। একবার যখন জান্‌ব, এর মূলে কে?” বলিয়া দুই হাতের নোখ এক করিয়া কহিল,—“তখন এই এম্‌নি ক’রে ছিঁড়ে ফেল্‌ব।” রমা মনে মনে শিহরিয়া উঠিল। বেণী কহিতে লাগিল,—“হারামজাদা ব্যাটারা, এ বুঝিস্‌নে যে, যার জোরে তোরা জোর করিস্‌ সেই রমেশ নিজে যে জেলে ঘানি টান্‌চে! তোদের মার্‌তে কতটুকু সময় লাগে?” রমা কোন কথা কহিল না। যে কাজের জন্য আসিয়াছিল, তাহা শেষ করিয়া নিঃশব্দে চলিয়া গেল। দেড়মাস হইল, রমেশ অবৈধ প্রবেশ করিয়া, ভৈরবকে ছুরি মারার অপরাধে, জেল খাটিতেছে!—মকদ্দমায় বাদীর পক্ষে বিশেষ পরিশ্রম করিতে হয় নাই,—নূতন ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব কি করিয়া পূর্ব্বাহ্ণেই জ্ঞাত হইয়াছিলেন, এ প্রকার অপরাধ আসামীর পক্ষে খুবই সম্ভব এবং স্বাভাবিক। এমন কি, সে ডাকাতি প্রভৃতির সহিত সংশ্লিষ্ট কি না, সে বিষয়েও তাঁহার যথেষ্ট সংশয় আছে। থানার কেতাব হইতেও তিনি বিশেষ সাহায্য পাইয়াছেন। তাহাতে লেখা আছে, ঠিক এই ধরনের অপরাধ সে পূর্ব্বেও করিয়াছে, এবং আরও অনেক প্রকার সন্দেহজনক ব্যাপার তাহার নামের সহিত জড়িত আছে। ভবিষ্যতে পুলিস যেন তাহার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখে, তিনি এ মন্তব্য প্রকাশ করিতেও ছাড়েন নাই। বেশী সাক্ষ্য-প্রমাণের প্রয়োজন হয় নাই, তবে রমাকে সাক্ষ্য দিতে হইয়াছিল। সে কহিয়াছিল, “রমেশ বাড়ী ঢুকিয়া আচার্য্য মহাশয়কে মারিতে আসিয়াছিল, তাহা সে জানে। কিন্তু ছুরি মারিয়াছিল কি না, জানে না, হাতে তাহার ছুরি ছিল কি না, তাহাও তাহার স্মরণ হয় না।” কিন্তু এই কি সত্য? জেলার বিচারালয়ে হলফ্‌ করিয়া রমা এই সত্য বলিয়া আসিল; কিন্তু যে বিচারালয়ে হলফ্‌ করার প্রথা নাই, সেখানে সে কি জবাব দিবে! তাহার অপেক্ষা কে অধিক নিঃসংশয়ে জানিত, রমেশ ছুরিও মারে নাই, হাতে তাহার অস্ত্র থাকা ত দূরের কথা, একটা তৃণ পর্য্যন্ত ছিল না। সে আদালতে এ কথা ত কেহ তাহাকে জিজ্ঞাসা পর্য্যন্ত করিবে না, সে কি স্মরণ করিতে পারে এবং কি পারে না! কিন্তু এখানকার আদালতে সত্য বলিবার যে তাহার এতটুকু পথ ছিল না! বেণী প্রভৃতির হাতধরা পল্লী-সমাজ সত্য চাহে নাই। সুতরাং সত্যের মূল্যে তাহাকে যে মিথ্যা অপবাদের গাঢ় কালী নিজের মুখময় মাখিয়া, এই সমাজের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইতে হইবে—এমন ত অনেকেই হইয়াছে—এ কথা সে যে নিঃসংশয়ে জানিত। তা ছাড়া, এত বড় গুরুদণ্ডের কথা, রমা স্বপ্নেও কল্পনা করে নাই। বড় জোর দু’শ-একশ’ জরিমানা হইবে, ইহাই জানিত। বরঞ্চ, বার বার সতর্ক করা সত্ত্বেও রমেশ যখন তাহার কাজ ছাড়িয়া কোনমতেই পলাইতে স্বীকার করে নাই, তখন রাগ করিয়া রমা মনে মনে এ কামনাও করিয়াছিল, হৌক জরিমানা। একবার শিক্ষা হইয়া যাক্‌। কিন্তু সে শিক্ষা যে এমন করিয়া হইবে, রমেশের রোগক্লিষ্ট পাণ্ডুর মুখের প্রতি চাহিয়াও বিচারকের দয়া হইবে না—একেবারে ছয় মাস সশ্রম-কারাবাসের হুকুম করিয়া দিবে—তাহা সে ভাবে নাই। সেই সময়ে রমা নিজে রমেশের দিকে চাহিয়া দেখিতে পারে নাই। পরের মুখে শুনিয়াছিল, রমেশ একদৃষ্টে তাহারই মুখের পানে চাহিয়াছিল, এবং জেলের হুকুম হইয়া গেলে, গোপাল সরকারের প্রার্থনার উত্তরে মাথা নাড়িয়া কহিয়াছিল,—“না। ম্যাজিষ্ট্রেট আমাকে সারাজীবন কারারুদ্ধ করবার হুকুম দিলেও আমি আপিল করিয়া খালাস পেতে চাহি না। বোধ করি, জেল এর চেয়ে ভাল।”

 ভালই ত! তাহাদের চিরানুগত ভৈরব আচার্য্য মিথ্যা নালিশ করিয়া যখন তাহার ঋণ-শোধ করিল, এবং রমা সাক্ষ্য-মঞ্চে দাঁড়াইয়া স্মরণ করিতে পারিল না, তাহার হাতে ছুরি ছিল কি না, তখন আপিল করিয়া মুক্তি চাহিবে সে কিসের জন্য! তাহার সেই দুর্জ্জয় ঘৃণা বিরাট্‌ পাষাণখণ্ডের মত রমার বুকের উপর চাপিয়া বসিয়া আছে—কোথাও তাহাকে সে নড়াইয়া রাখিবার স্থান পাইতেছে না! সে কি গুরুভার! সে মিথ্যা বলিয়া আসে নাই—এ কৈফিয়ত তাহার অন্তর্যামী ত কোনমতেই মঞ্জুর করিল না! মিথ্যা বলে নাই বটে, কিন্তু সত্য প্রকাশও করে নাই। সত্যগোপনের অপরাধ যে এত বড়, সে যে এমন করিয়া তাহাকে অহরহ দগ্ধ করিয়া ফেলিবে, এ যদি সে একবার জানিতে পারিত! রহিয়া রহিয়া তাহার কেবলই মনে পড়ে, ভৈরবের যে অপরাধে রমেশ আত্মহারা হইয়াছিল, সে অপরাধ কত বড়! অথচ, তাহার একটিমাত্র কথায় সে সমস্ত মার্জ্জনা করিয়া,—দ্বিরুক্তি না করিয়া, চলিয়া গিয়াছিল! তাহার ইচ্ছাকে এমন করিয়া শিরোধার্য্য করিয়া কে কবে, তাহাকে এত সম্মানিত করিয়াছিল! নিজের মধ্যে পুড়িয়া পুড়িয়া আজকাল একটা সত্যের সে যেন দেখা পাইতেছিল! যে সমাজের ভয়ে সে এত বড় গর্হিত কর্ম্ম করিয়া বসিল, সে সমাজ কোথায়? বেণী প্রভৃতি কয়েকজন সমাজপতির স্বার্থ ও ক্রূর হিংসার বাহিরে কোথাও কি তাহার অস্তিত্ব আছে? গোবিন্দের এক বিধবা ভ্রাতৃবধূর কথা কে না জানে? বেণীর সহিত তাহার সংস্রবের কথা গ্রামের মধ্যে কাহারও অবিদিত নাই। অথচ সমাজের আশ্রয়ে সে নিষ্কণ্টকে বসিয়া আছে; এবং এই বেণীই সমাজপতি। তাহারই সামাজিক-শৃঙ্খল সর্ব্বাঙ্গে শতপাকে জড়াইয়া রাখাই চরম সার্থকতা! ইহাই হিঁদুয়ানী! কিন্তু যে ভৈরব এত অনর্থের মূল, রমা নিজের দিকে চাহিয়া তাহার উপরেও আর রাগ করিতে পারিত না। মেয়ে তাহার বারো বছরের হইয়াছে—অতি শীঘ্র বিবাহ দিতে না পারিলে ‘একঘরে’ হইতে হইবে—এবং বাড়ীশুদ্ধ লোকের জাত যাইবে। এ প্রমাদের আশঙ্কামাত্রেই ত প্রত্যেক হিন্দুর হাত-পা পেটের ভিতরে ঢুকিয়া যায়! সে নিজে তাহার এত সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সে সমাজের ভয় কাটাইতে পারে নাই—গরীব ভৈরব কাটাইবে কি করিয়া! বেণীর বিরুদ্ধতা করা তাহার পক্ষে কি ভয়ানক মারাত্মক ব্যাপার, এ কথা ত কোনমতেই সে অস্বীকার করিতে পারে না।

 বৃদ্ধ সনাতন হাজরা বাটীর সম্মুখ দিয়া যাইতেছিল, গোবিন্দ দেখিতে পাইয়া ডাকা-ডাকি, অনুনয়-বিনয়, শেষকালে একরকম জোর করিয়া ধরিয়া আনিয়া বেণীবাবুর সাম্‌নে হাজির করিয়া দিল। বেণী গরম হইয়া কহিল,—“এত দেমাক কবে থেকে হ’ল রে সনাতন? বলি, তোদের ঘাড়ে কি আজকাল আর একটা ক’রে মাথা গজিয়েচে রে!” সনাতন কহিল,—“দুটো ক’রে মাথা আর কার থাকে বড়বাবু? আপনাদেরই থাকে না ত, আমাদের মত গরীবের!” “কি বল্‌লি রে!” বলিয়া হাঁক দিয়া বেণী ক্রোধে নির্ব্বাক্‌ হইয়া গেল; ইহারই সর্বস্ব যেদিন বেণীর হাতে বাঁধা ছিল, তখনই এই সনাতন দুবেলা আসিয়া বড়বাবুর পদলেহন করিয়া যাইত—আজ তাহারই মুখে এই কথা! সনাতন কহিল,—“দুটো মাথা কারো থাকে না, সেই কথাই বলেচি বড়বাবু, আর কিছু নয়।” গোবিন্দ রসান দিয়া কহিল,—“তোদের বুকের পাটা শুধু দেখ্‌চি আমরা! মায়ের প্রসাদ পেতেও কেউ তোরা এলি নে, বলি, কেন বল্‌ ত রে?” বুড়া একটুখানি হাসিয়া কহিল,—“আর বুকের পাটা! যা করবার, সে ত আপনারা আমার করেচেন। সে যাক্‌, কিন্তু মায়ের প্রসাদই বলুন, আর যাই বলুন, কোন কৈবর্ত্তই আর বামুন-বাড়ীতে পাত পাত্‌বে না। এত পাপ যে মা বসুমতী কেমন ক’রে সইচেন, তাই আমরা কেবল বলাবলি করি!” বলিয়া একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া সনাতন রমার প্রতি চাহিয়া কহিল,—“একটু সাবধানে থেকো দিদিঠাক্‌রুণ, পীরপুরের মোচনমান ছোঁড়ারা একেবারে ক্ষেপে রয়েচে। ছোটবাবু ফিরে এলে যে কি কাণ্ড হবে, তা ঐ মা দুর্গাই জানেন। এর মধ্যেই দুটো তিন্‌টে বার তারা বড়বাবুর বাড়ীর চারপাশে ঘুরেফিরে গেছে—সাম্‌নে পায়নি, তাই রক্ষে!” বলিয়া সে বেণীর দিকে চাহিল। চক্ষের নিমেষে বেণীর ক্রুদ্ধ মুখ ভয়ে বিবর্ণ হইয়া গেল। সনাতন কহিতে লাগিল,—“ঠাকুরের সুমুখে মিথ্যে বল্‌চিনে বড়বাবু, একটু সাম্‌লে-সুম্‌লে থাক্‌বেন। রাত-বিরিতে বার হবেন না—কে কোথায় ওত পেতে ব’সে থাক্‌বে, বলা যায় না ত!” বেণী কি একটা বলিতে গেল, কিন্তু মুখ দিয়া তাহার কথা বাহির হইল না! তাহার মত ভীরু লোক বোধ করি সংসারে ছিল না।

 এতক্ষণে রমা কথা কহিল। স্নেহার্দ্র করুণকণ্ঠে প্রশ্ন করিল,—“সনাতন, ছোটবাবুর জন্যেই বুঝি তোমাদের সব এত রাগ?” সনাতন প্রতিমার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল,—“মিথ্যে ব’লে আর নরকে যাব কেন দিদিঠাক্‌রুণ, তাই বটে! তবে, মোচনমানদের রাগটাই সবচেয়ে বেশি। তারা ছোটবাবুকে হিঁদুদের পয়গম্বর মনে করে। তার সাক্ষী দেখুন, আপনারা—জাফর আলি, আঙুল দিয়ে যার জল গলে না, সে ছোটবাবুর জেলের দিন তাদের ইস্কুলের জন্যে একটি হাজার টাকা দান করেচে! শুনি মস্‌জিদে তাঁর নাম ক’রে নাকি নেমাজপড়া পর্য্যন্ত হয়।” রমার শুষ্ক ম্লান মুখখানি অব্যক্ত-আনন্দে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। সে চুপ করিয়া প্রদীপ্ত নির্নিমেষ চোখে সনাতনের মুখের পানে চাহিয়া রহিল। বেণী অকস্মাৎ সনাতনের হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিল,—“তোকে একবার দারোগার কাছে গিয়ে বল্‌তে হবে সনাতন! তুই যা’ চাইবি তাই তোকে দেব, দু’বিঘে জমি ছাড়িয়ে নিতে চাস্‌ ত তাই পাবি, ঠাকুরের সাম্‌নে দাঁড়িয়ে দিব্যি কর্‌চি সনাতন, বামুনের কথাটা রাখ্‌।” সনাতন বিস্মিতের মত কিছুক্ষণ বেণীর মুখপানে চাহিয়া থাকিয়া কহিল,—“আর ক'টা দিন বা বাঁচ্‌ব বড়বাবু! লোভে পড়ে যদি এ কাজ করি, মর্‌লে আমাকে তোলা চুলোয় যাক্‌, পা দিয়েও কেউ ছোঁবে না! সে দিন-কাল আর নেই বড়বাবু,—সে দিন-কাল আর নেই! ছোটবাবু সব উল্‌টে দিয়ে গেছে।” গোবিন্দ কহিল,—“বামুনের কথা তা হ’লে রাখ্‌বিনে বল্‌?” সনাতন মাথা নাড়িয়া বলিল,“না। বল্‌লে তুমি রাগ কর্‌বে গাঙ্গুলিমশাই, কিন্তু, সেদিন পীরপুরের নূতন ইস্কুলঘরে ছোটবাবু বলেছিলেন, ‘গলায় গাছকতক সুতো ঝোলানো থাক্‌লেই বামুন হয় না।’ আমি ত আর আজকের নয় ঠাকুর, সব জানি। যা ক’রে তুমি বেড়াও, সে কি বামুনের কাজ? তোমাকেই জিজ্ঞাসা কর্‌চি, দিদিঠাক্‌রুণ, তুমিই বল দেখি?” রমা নিরুত্তরে মাথা হেঁট করিল। সনাতন উৎসাহিত হইয়া মনের আক্রোশ মিটাইয়া বলিতে লাগিল,—“বিশেষ ক’রে ছোঁড়াদের দল। ছোটবাবুর জেল হওয়া থেকে এই দুটো গাঁয়ের যত ছোকরা, সন্ধ্যের পর সবাই গিয়ে জোটে জাফর আলির বাড়ীতে। তারা ত চারিদিকে, পষ্ট ব’লে বেড়াচ্চে, জমিদার ত ছোটবাবু! আর সব চোর-ডাকাত। তা ছাড়া খাজনা দিয়ে বাস কর্‌ব—ভয় কারুকে কর্‌ব না। আর বামুনের মত থাকে ত বামুন, না থাকে আমরাও যা’ তারাও তাই।” বেণী আতঙ্কে পরিপূর্ণ হইয়া শুষ্কমুখে প্রশ্ন করিল,—“সনাতন, আমার ওপরেই তাদের এত রাগ কেন, বল্‌তে পারিস্‌?” সনাতন কহিল,—“রাগ কোরো না বড়বাবু, কিন্তু আপনি যে সকল নষ্টের গোড়া, তা তাদের জান্‌তে বাকী নেই।” বেণী চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। ছোটলোক সনাতনের মুখে এমন কথাটা শুনিয়াও সে রাগ করিল না, কারণ, রাগ করিবার মত মনের অবস্থা তাহার ছিল না—তাহার বুকের ভিতর ঢিপ-ঢিপ করিতেছিল। গোবিন্দ কহিল,—“তা হ’লে জাফরের বাড়ীতেই আড্ডা বল্‌? সেখানে তারা কি করে, বলতে পারিস্‌?” সনাতন তাঁহার মুখপানে চাহিয়া কি যেন চিন্তা করিল। শেষে কহিল,—“কি করে তারা, জানিনে, কিন্তু ভাল চাও ত সে মতলব কোরো না ঠাকুর। তারা হিন্দুমুসলমান ভাই সম্পর্ক পাতিয়েচে—এক মন, এক প্রাণ। ছোটবাবুর জেল হওয়া থেকে, সব রাগে বারুদ হয়ে আছে, তার মধ্যে গিয়া চক্‌মকি ঠুকে আগুন জ্বাল্‌তে যেও না ঠাকুর!”

 সনাতন চলিয়া গেলে, বহুক্ষণ পর্য্যন্ত কাহারও কথা কহিবার প্রবৃত্তি রহিল না। রমা উঠিয়া যাইবার উপক্রম করিতে বেণী বলিয়া উঠিল,—“ব্যাপার শুনলে রমা?” রমা মুচকিয়া হাসিল, কথা কহিল না। হাসি দেখিয়া বেণীর গা জ্বলিয়া গেল, কহিল,—“শালা ভৈরবের জন্যেই এত কাণ্ড। আর তুমি না যাবে সেখানে, না তাকে ছাড়িয়ে দেবে, এ সব কিছুই হ’ত না। তুমি ত হাস্‌বেই রমা, মেয়েমানুষ, বাড়ীর বার হ’তে ত হয় না, কিন্তু আমাদের উপায় কি হবে বল ত? সত্যিই যদি একদিন আমার মাথাটা ফাটিয়ে দেয়? মেয়েমানুষের সঙ্গে কাজ কর্‌তে গেলেই এই দশা হয়।” বলিয়া বেণী ভয়ে, ক্রোধে, জ্বালায় মুখখানা কি একরকম করিয়া বসিয়া রহিল। রমা স্তম্ভিত হইয়া রহিল। বেণীকে সে ভালমতেই চিনিত, কিন্তু, এত বড় নির্লজ্জ অভিযোগ সে তাহার কাছেও প্রত্যাশা করিতে পারিত না। কোন উত্তর না দিয়া, কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া, সে অন্যত্র চলিয়া গেল। বেণী তখন হাঁক-ডাক করিয়া গোটা দুই আলো এবং ৫।৬ জন লোক সঙ্গে করিয়া আশে-পাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখিয়া ত্রস্ত ভীতপদে প্রস্থান করিল।