নব্য-বঙ্গের সাহিত্যে প্রতীচ্য সাহিত্যের প্রভাব সুষ্পষ্ট। বাঙ্গালা কাব্যেও বিদেশী ভাবের প্রভাব অল্প নহে। বাঙ্গালীর নূতন গীতি-কবিতাতেও প্রতীচ্য দুঃখবাদের ছায়া পড়িয়াছে। বাঙ্গালার অনেক কবি এই দুঃখবাদের প্রভাবে অভিভূত হইয়াছেন। বড়ালকবিও সে প্রভাব অতিক্রম করিতে পারেন নাই। তাঁহার কাব্যও দুঃখবাদ আছে; কিন্তু তাহা গতানুগতিক বা প্রতীচ্য দুঃখবাদের 'হুবহু' প্রতিধ্বনি নহে। তাঁহার কবিতায় 'পেসিমিজম্' আছে বটে, কিন্তু তাহা প্রতীচীর 'নিহিলিজম্' নহে।
প্রতীচ্য দুঃখবাদের প্রভাব ভয়ঙ্কর, তাহা মানবকল্যানের— বিশ্বহিতের পরিপন্থী। ভারতের প্রাচীন সাহিত্যে ও দর্শনে দুঃখবাদ নাই, এমন নহে; কিন্তু প্রতীচ্য ও প্রাচ্য দুঃখবাদে প্রভেদ আছে। প্রতীচীর দুঃখবাদ অনেক ক্ষেত্রে 'নিহিলিজমে'র—নাশের প্রবর্ত্তক। দুঃখে তাহার উৎপত্তি, কিন্তু দুঃখেই তাহার নিবৃত্তি নহে। সে দুঃখবাদের প্রভাবে মানব অন্ধ হয়; নিরাশায় বেদনায় মানবের মন মথিত হয়; উদভ্রান্তের উন্মত্ত তাণ্ডবে মনব-সমাজ বিপর্য্যস্ত হয়; নিরাশ নিরুপায়, দুঃখপিষ্ঠ মানব অতীতের স্মৃতি মুছিয়া ফেলিয়া বর্তমানকেই সকল দুঃখের হেতু কল্পনা করিয়া, তাহার সর্ব্বস্ব চুর্ণ বিচূর্ণ করিবার জন্য দানব-শক্তির আবাহন করে; দুঃখবাদের জ্বালামুখী অগ্নিধারার উদগার করে; সমাজের ভিত্তি পর্য্যন্ত সে বিপ্লবে বিধ্বস্ত হইবার সম্ভবনা ঘটে। ইহার ফল নাস্তিকতা, ইহার ফল নাশ, মৃত্যু।
প্রাচ্য দুঃখবাদ এত উগ্র, এত ক্ষিপ্ত, এত প্রচণ্ড নহে। আমাদের দুঃখবাদ সাত-সমুদ্র-তেরো-নদীর-পারের দুঃখবাদের মত অন্ধও নহে। জগৎ নিরবিচ্ছিন্ন সুখের লীলাভূমি নহে। মৃন্ময়ী আমাদের জন্য দুঃখের পসরাও সাজাইয়া রাখিয়াছেন। সেদিনও বৈষ্ণব কবি গায়িয়াছেন,—'সুখ দুখ দুটি ভাই।' সুখই মানবের কাম্য, দুঃখ নহে। ভারতবাসীও দুঃখে মথিত হইয়াছে, কিন্তু উদভ্রান্ত হইয়া নূতন দূঃখের সৃষ্টি করে নাই। ভারতের দার্শনিক বলেন,— 'দুঃখাত্যন্ত-নিবৃত্তিঃ পরম-পুরুষার্থঃ'। তাঁহারা দুঃখের মূল উৎসের সন্ধান করিয়াছেন, এবং মানবকে সেই দুস্তর দুঃখ উত্তীর্ণ হইবার সেতু দেখাইয়া দিয়াছেন। দুঃখের অত্যন্ত-নিবৃত্তিই পরমপুরুষার্থ। তাহাই মানবের কর্ত্তব্য। দুঃখ হইতে দুঃখান্তরের সৃষ্টি ও ধারাবাহিক দুঃখপরম্পরার ভোগ পুরুষার্থ নহে। ভারতের দুঃখবাদে আশা আছে, আশ্বাস আছে, দুঃখনিবৃত্তির উপায় আছে। বেদাদি তাহার পথনির্দ্দেশ করিয়াছেন। হিন্দু দুঃখে অভিভূত হয়, পিষ্ট হয় না; সে দুঃখ অতিক্রম করিবার চেষ্টাই তাহার পরমপুরুষার্থ। হিন্দুর দুঃখবাদ— আধ্যাত্মিকতার সিংহদ্বার। তাহার পর সুখবাদের নন্দন। তাহার পর আত্মজ্ঞানের তপোবন। এই তপোবনে সিদ্ধিলাভ করিয়া সাধক সুখ-দুঃখের অতীত হন, ভূমানন্দ লাভ করেন। এ দুঃখবাদে অবিশ্বাস নাই, নাস্তিকতা নাই।