পাতা:অপু-পথের পাঁচালী-অপরাজিত.pdf/৩৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

একটা অপূর্ব আনন্দ হয়। ছোট তোরঙ্গ ও বিছানাটার মোট লইয়া জানালার ধারে বসিয়া চাহিয়া দেখিতে দেখিতে কত কথা মনে আসিতেছিল। এখন সে কত বড় হইয়াছে-একা একা ট্রেনে চড়িয়া বেড়াইতেছে। তারপর এমনি একদিন হয়ত নীল নদের তীরে, ক্লিওপেট্রার দেশে-এক জোৎস্না রাতে শত শত প্রাচীন সমাধির বুকের উপর দিয়া অজানা সে যাত্রা । স্টেশনে নামিয়া বাড়ি যাইবার পথে একটা গাছতলা দিয়া যাইতে যাইতে মাঝে মাঝে কেমন একটা সুগন্ধ-মাটির, ঝরা পাতার কোন ফুলের। ফাঙ্কনের তপ্ত রৌদ্র গাছে গাছে পাতা ঝরাইয়া দিতেছে, মাঠের ধারে অনেক গাছে নতুন পাতা গজাইয়াছে।--পলাশের ডালে রাঙা রাঙা নতুন ফোটা ফুল যেন আরতির পঞ্চপ্রদীপের উধ্বমুখী শিখার মত জলিতেছে। অপুর মন যেন আনন্দে শিহরিয়া ওঠে-যদিও সে ট্রেনে আজ সারা পথ শুধু নিৰ্মলা আর দেবব্রতের কথা ভাবিয়াছে-কখনো শুধুই নির্মলা, কখনো শুধুই দেবব্রত-তাহার স্কুলজীবনে এই দুইটি বন্ধু যতটা তাহার প্রাণের কাছাকাছি আসিয়াছিল, অতটা নিকটে অমনভাবে আর কেহ আসিতে পারে নাই, তবুও তাহার মনে হয় আজকের আনন্দের সঙ্গে নির্মলার সম্পর্ক নাই, দেবব্রতের নাই-আছে তার নিশ্চিন্দিপুরের বাল্যজীবনের স্নিগ্ধস্পৰ্শ, আর বহুদূর-বিসৰ্পিত, রহস্যময় কোন অন্তরের ইঙ্গিত-সে। মনে বালক হইলেও এ-কথা বোঝে । প্রথম যৌবনের শুরু, বয়ঃসন্ধিকালের রূপ ফাটিয়া পড়িতেছে-এই ছায়া, বকুলের গন্ধ, বানান্তরে অবসন্ন ফাঙ্কনদিনে পাখির ডাক, ময়ুরকষ্ঠ রং-এর আকাশটা-রক্তে যেন এদের নেশা লাগে—গর্ব, উৎসাহ, নবীন জীবনের আনন্দভরা প্রথম পদক্ষেপ। নির্মলা তুচ্ছ! আর এক দিক হইতে ডাক আসে-অপু আশায় আশায় থাকে। নিরাবরণ মুক্ত প্রকৃতির এ আহ্বান, রোমান্সের আহ্বান-তার রক্তে মেশানো, এ আসিয়াছে তাহার বাবার নিকট হইতে উত্তরাধিকারসূত্রেবন্ধনমুক্ত হইয়া ছুটিয়া বাহির হওয়া, মন কি চায় না-বুঝিয়াই তাহার পিছু পিছু দৌড়ানো, এ তাহার নিরীহ শাস্ত-প্রকৃতি ব্রাহ্মণপণ্ডিত পিতামহ রামহরি তর্কালঙ্কারের দান নয়—যদিও সে তার নিম্পূহ জ্ঞানপিপাসা ও অধ্যয়নপ্রিয়তাকে লাভ করিয়াছে বটে। কে জানে পূর্ব-পুরুষ ঠ্যাঙাড়ে বীরু রায়ের উচ্ছঙ্খল রক্ত আছে কি-না- তাই তাহার মনে হয় কি যেন একটা ঘটবে, তাহারই প্রতীক্ষায় থাকে। অপূর্ব গন্ধে-ভরা বাতাসে, নবীন বসন্তের শু্যামল শ্রীতে, অস্তসূর্যের রক্ত আভায় সে রোমান্সের বার্তা যেন লেখা থাকে।