সঙ্গে নেচে চলত। কোনো নৌকোয় নাচগান হচ্ছে, কোনো নৌকোয় রান্নার কালে হাড়ি চড়েছে, দূর থেকে দেখা যেত আগুনের শিথা । স্নানযাত্রীদের নৌকো সব চলেছে পর পর। রাতের অন্ধকারে সেও আরএক শোভা গঙ্গার । গঙ্গার সঙ্গে অতিনিকট সম্বন্ধ তেমন ছিল না ; চাকররা মাঝে মাঝে গঙ্গাতে স্নান করাতে নিয়ে যেত, ভালো লাগত না, তাদের হাত ধরেই ছ বার জলে ওঠানামা করে ডাঙার জীব ডাঙায় উঠে পালিয়ে বঁাচতুম। কিন্তু দেখেছি, এমন দেখেছি যে দেখার ভিতর দিয়েই গঙ্গাকে অতি কাছে পেয়েছি । তার পর বড়ো হয়ে আর-একবার গঙ্গাকে আর-এক মূতিতে দেখি। খুব অস্থখ থেকে ভুগে উঠেছি, নিজে ওঠবার বসবার ক্ষমতা নেই। ভোর ছটায় তখন ফেরি স্টীমার ছাড়ে, জগন্নাথ ঘাট থেকে শিবতলা ঘাট হয়ে ফেরে নট! সাড়ে নটার। বিকেলেও যায়, আপিসের বাবুদের পৌছে দিয়ে আসে। ঘন্ট দুই-আড়াই লাগে। ডাক্তার বললেন, গঙ্গার হাওয়া খেলে সেরে উঠব তাড়াতাড়ি। নির্মল আমায় ধরে এনে বসিয়ে দিলে ষ্টীমারের ডেকে একটা চেয়ারে। মনে হল যেন গঙ্গাযাত্রী করতে চলেছি, এমনি তখন অবস্থ৷ আমার। কিন্তু সাতদিন যেতে না-যেতে গঙ্গার হাওয়ায় এমন সেরে উঠলুম, নির্মলকে বললুম, আর তোমায় আসতে হবে না,-আমি একাই যাওয়া-আসা করতে পারব ।” সেই দেখেছি সেবারে গঙ্গার রূপ। গ্রীষ্ম বর্ষ শরৎ হেমন্ত শীত বসন্ত কোনো ঋতুই বাদ দিই নি, সব ঋতুতেই মা গঙ্গাকে দেখেছি। এই বর্ষাকালে ছুকূল ছাপিয়ে জল উঠেছে গঙ্গার—লাল টকটক করছে। জলের রঙ— তোমরা খোয়াই-ধোয় জলের কথা বল ঠিক তেমনি, তার উপরে গোলাপিপাল-তোলা ইলিশ মাছের নেীকে এ দিকে ও দিকে দুলে দুলে বেড়াচ্ছে, সে কী সুন্দর । তার পর শীতকালে বসে আছি ডেকে গরম চাদর গায়ে জড়িয়ে, উত্তরে হাওয়া মুখের উপর দিয়ে কানের পাশ ঘেষে বয়ে চলেছে হু হু করে। সামনে ঘন কুয়াশা, তাই ভেদ করে স্টীমার চলেছে একটান। সামনে কিছুই দেখা যায় না। মনে হত যেন পুরাকালের ভিতর দিয়ে নতুন যুগ চলেছে কোন রহস্য উদঘাটন করতে। থেকে থেকে হঠাৎ একটি দুটি নৌকো সেই..ঘন কুয়াশার ভিতর থেকে স্বপ্নের মতো বেরিয়ে আসত। ২৯২
পাতা:অবনীন্দ্র রচনাবলী প্রথম খণ্ড.djvu/৩০৯
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।