আবার বোট ছেড়ে দিতেন। বরাবরের এই ব্যবস্থা ছিল । এবারে ছেলেদের জিজ্ঞেস করলুম, ‘ওরে, সেই চর কোথায় গেল ? দেখছি নে যে। গঙ্গার কি সবই বদলে গেল ? এ যে সেই গঙ্গা বলে আর চেনাই দায়।’ তা, সেই তখন একদিন দেখলুম। সে যে কী ভালো লেগেছিল। স্টীমার চলেছে খেয়া থেকে যাত্রী তুলে নিয়ে। সামনে চর, যেন ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা মধ্যিখানে চর, তার মাঝে বসে আছে শিৰু সদাগর।’ ও পাশের ঘাটে একটি ডিঙিনৌকা। ছোট গ্রামের ছায় পড়েছে ঘাটে। ডিঙিনৌকায় ছোট একটি বউ লাল চেলি পরে বসে—শ্বশুরবাড়ি যাবে, কাদছে চোখে লাল আঁচলটি দিয়ে, পাশে বুড়ি দাই গায়ে হাত বুলিয়ে সান্থন দিচ্ছে, নদীর এপার বাপের বাড়ি, ওপার শ্বশুরবাড়ি—ছোট বউ কেঁদেই সারা ওইটুকু রাস্ত পেরোতে । সে যে কী সুন্দর দৃশু, কী বলব তোমায়। মনের ভিতর আঁকা হয়ে রইল সেদিনের সেই ছবি, আজও আছে ঠিক তেমনটিই। এমনি কত ছবি দেখেছি তখন । গঙ্গার দু দিকে কত বাড়িঘর, মিল, ভাঙা ঘাট, কোথাও-বা দ্বাদশ মন্দির, চৈতন্তের ঘাট, বট গাছটি গঙ্গার ধারে ঝুকে পড়েছে, তারই নীচে এসে বসেছিলেন চৈতন্যদেব—গদাধরের পাট, এই-সব পেরিয়ে স্টীমার চলত এগিয়ে । গান হৈ-হল্লার ফঁাকে ফাঁকে দেখাও চলত সমানে । এই দেখার জন্য ছেলে বেলার এক বন্ধুকে কেমন একদিন তাড়া লাগিয়েছিলুম। বলাই, ছেলেবেলায় একসঙ্গে পড়েছি—অসুখে ভোগার পর একদিন দেখি সেও এসেছে স্ট্রীমারে, দেখে খুব খুশি। খানিক কথাবার্তার পর সে পকেট থেকে একটি বই বের করে পাতা খুলে চোখের সামনে ধরলে, দেখি একখানি গীতা । একমনে পড়েই চলল, চোখ আর তোলে না পুথির পাতা থেকে। বললে, ‘মা বলে দিয়েছেন গীত পড়তে, আমায় বিরক্ত কোরো না।’ বললুম, বলাই, ও বলাই, বইটা রাখ-না ; কী হবে ও-বই পড়ে, চেয়ে দেখ দেখিনি কেমন দুপাত খোলা রয়েছে সামনে, আকাশ আর জল, এতেই তোর গীতার সব-কিছু পাবি ৷ দেখ না, একবারটি চেয়ে দেখ ভাই।’ বলাই মুখ তোলে না। মহা মুশকিল ! ধর্ম্মকর্ম্ম আমুর সয় না। কোনোকালে করিও নি। ওসব দিকই মাড়াই নে। প্রথম-প্রথম যখন আসি স্ট্রীমারে, একদিন পিছনে সেকেণ্ড ক্লাসে বসে কেরানিবাবুর এ ওর গায়ে ঠেলা মেরে চোখ ইশারা করে বলছে, ‘কে রে, এ কে এল ? একজন বললে, ‘অবন ঠাকুর, ঠাকুরবাড়ির ছেলে ।” আর ३38
পাতা:অবনীন্দ্র রচনাবলী প্রথম খণ্ড.djvu/৩১১
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।