বীর হত— যেন রাতের শিকারী জন্তু খুঁজত। এটা ওটা সেটা এদিক ওদিক সেদিক সন্ধানে চলত সেদিনের আমিও তক্তার নীচে, সিড়ির কোণে, সার্সির ফঁাকে, আয়নার উলটো পিঠে এবং চৌকি বেয়ে আলমারির চালে নান জিনিস আবিষ্কার করার দিকে। ছাতের কথা ভুলেই যাই– তখন ঘর দেখতেই মশগুল থাকে মন! এক ছোটো ছেলেমেয়েদের ছাড়া এই সময়টাতে খানিকক্ষণের মতে কাউকে পেত না তিনতলার ঘরগুলো । কাজেই এ-সময়ে আমাদের সঙ্গে যেন ছাড়া পেয়ে জিনিসগুলোও হঠাৎ বেঁচে উঠত, এবং তারাও বেরিয়েছে দিনদুপুরের অন্ধকারে খেলার চেষ্টায়— এটা ভাবে জানাত। সারা তিনতলার দেওয়াল, ছবি, সিড়ি, তক্তা, আলমারি, ফুলদানি, মায় মেঝেতে পাতা মস্ত জাজিম এবং কড়িতে ঝোলানো পাখাগুলোর সঙ্গে এমনি করে দুপুরে ঘরে ঘরে ফিরে আর উকি দিয়ে, সারা তিনতল। কতদিনে পেয়েছিলেম, পুরোপুরি ভাবে তা বলা যায় না। একটা দোলনা-থাট— ছোট, সেটা খাট থাকতে থাকতে হঠাৎ কবে একদিন জাহাজ হয়ে উঠল এবং দুলে ছলে আমাদের নিয়ে সমুদ্রে চলাচল শুরু করলে। মস্ত জাজিম বিছানা ক’জোড়া ছোটো হাতের তাড়ায় যেন ফুলে ফুলে উঠল— যেন ক্ষীর সাগরে ঢেউ তুলে। তক্তার উপরটার চেয়ে তক্তার নীচেট কবে ষে আপনাকে ভারি নিরিবিলি আরামের জায়গা বলে জানিয়েছিল কোন তারিখে, কোন বছরে, কতকাল আগেই বা— তা কি মনে থাকে ? জানি নে, ভুলে গেছি, এই হল উত্তর তারিখের বেলায়। কিন্তু জিনিসের বেলাতে একেবার তা নয়— এখনো পঞ্চাশ বছর আগেকার ঘরে ঘরে কোথায় কী তা স্পষ্ট দেখছি আমি— জিনিসগুলোকে একটুও ভুলি নি। কিন্তু আশ্চর্য এই, মানুষদের মধ্যে অনেকের চেহারাই লোপ পেয়ে গেছে এই তিনতলার থেকে, যেটার কথা আজ বলছি । কাঠের বেড়া দেওয়া দোলন-খাট জাহাজ-জাহাজ খেলে যে-কোণে বসে আমাদের সঙ্গে, সেখান থেকে দেখা যায় উত্তরে সরু একফালি দেওয়ালে ঝোলানো একটি ছোট্ট আলমারি— ওষুধ থাকে তার মধ্যে। এই অলিমারির চালে বসানো রয়েছে দেখি হলদে মাটির নাডুগোপাল । সে হামাগুড়ি দিতে দিতে হঠাৎ থেমে গিয়ে ডান হাতের মস্ত নাডুটা এগিয়ে দিয়ে চেয়ে আছেই আমার দিকে। এই গোপাল ছেলেটির পাশে দাড়িয়ে রয়েছে রোগাপান সরু গলার একটা নীল কাচের বোতল—রাঙা, হলুদ, কালো, শাদ রঙের ૨8
পাতা:অবনীন্দ্র রচনাবলী প্রথম খণ্ড.djvu/৩৩
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।