পাতা:অলৌকিক নয়, লৌকিক (দ্বিতীয় খণ্ড) - প্রবীর ঘোষ.pdf/২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৮
অলৌকিক নয়, লৌকিক ২

আর্যরাই ভারতে প্রথম সভ্যতার আলো এনেছে, এ কথা যেমন মিথ্যা, একইভাবে মিথ্যা ভারতের বর্তমান সভ্যজাতি গোষ্ঠীগুলো সবই আর্যদের থেকেই সৃষ্ট। এই চিন্তাই আমাদের আর্যজাতির বংশধর হিসেবে ভাবতে শিখিয়েছে প্রাক্ আর্য জাতিকে অনার্য, অসভ্য হিসেবে চিত্রিত করতে।

 আমাদের দেশের ‘হিন্দু’ জাতীয়তাবোধ পরিচালিত শিক্ষাব্যবস্থা সুলতান মামুদ এবং ঔরঙ্গজেবের মন্দির ধ্বংসকে ‘হিন্দু’ বিদ্বেষের এবং হিন্দুত্বের অপমানের প্রমাণ হিসেবে হাজির করেছে। একই সঙ্গে ষষ্ঠ শতকে হর্ষের একের পর এক হিন্দু মন্দির লুণ্ঠনের ঘটনা বিষয়ে নীরব থেকেছে। হর্ষ তো মন্দির লুণ্ঠনের জন্য ‘দেবোৎপাটননায়ক' নামে এক শ্রেণির রাজকর্মচারীরাই নিয়োগ করেছিলেন। মন্দির লুণ্ঠনের জন্য যদি মামুদ ও ঔরঙ্গজেব হিন্দু বিদ্বেষী হিসেবে চিত্রিত হন, তাতে হর্ষ একই কাজের জন্য কেন হিন্দু বিদ্বেষী হিসেবে চিত্রিত হবেন না?

 হর্ষের মন্দির লুণ্ঠন প্রসঙ্গে আমার এক ইতিহাসের অধ্যাপক বন্ধু জানিয়েছিলেন, “আমাদের আলোচনা করা উচিত শুধুমাত্র যুক্তির উপর নির্ভর করে নয়, বাস্তব অবস্থার বিশ্লেষণ করে। সে যুগে মন্দির শুধু দেবোপাসনার স্থল ছিল না, মন্দিরের গুপ্ত কক্ষে সঞ্চিত থাকত ভক্তদের দান ও শ্রেষ্ঠীদের রত্নরাশি। অর্থ ও রত্ন রাজ্য শাসনে অপরিহার্য। রাজ্য শাসনের স্বার্থেই রত্ন আহরণের জন্য হর্ষ মন্দিরে হাত দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।’

 এই যুক্তিই মামুদ বা ঔরঙ্গজেবের ক্ষেত্রে কেন প্রযোজ্য হবে না? গোটা হিন্দু যুগব্যাপী বীর-শৈব ও লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়গুলো যে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে বৌদ্ধ ও জৈন মন্দির মঠ পুঁথি ধ্বংস করে গেছেন, আমাদের দেশের ইতিহাসের বইগুলো সে বিষয়ে নীরব কেন?

 হিন্দুদের জোর করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার জন্য মুঘল যুগের শাসকদের ‘হিন্দু' ঐতিহাসিকরা যতই তাঁদের লেখনিতে অভিযুক্ত করুন, বাস্তবক্ষেত্রে কোনও মুঘল সম্রাটই কিন্তু গণ-ধর্মান্তরের চেষ্টায় নিজেদের নিয়োজিত করেননি। এমনকী ঔরঙ্গজেবও নন। সমস্ত প্রজাপুঞ্জকে রাজধর্মে দীক্ষিত করা নিন্দনীয়ই যদি হয়, তবে নিন্দার প্লাবনে ভাসিয়ে দেওয়া উচিত সম্রাট অশোককে। নিজ ধর্মে দীক্ষিত করতে তিনি কী না করেছেন? তবু তিনি মহান। তিনি ধর্মাশোক। তিনি শান্তি ও অহিংসার প্রতীক!