পাতা:আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী.djvu/৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাঙ্গালীর মস্তিষ্ক ও তাহার অপব্যবহার

সায়ংকাল পর্য্যন্ত, জন্ম হইতে মৃত্যু পর্য্যন্ত হিন্দু নিজকে এমন দৃঢ় নিগড়ে বন্ধন করিলেন যে, জীবনের যাহা কিছু কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য, স্বীয় স্বাধীনতা অম্লানবদনে বিসর্জ্জন দিয়া, তাহা শাস্ত্রের নির্দ্দেশ অনুসারে করিতেই হইবে ইহাই স্থিরনিশ্চয় করিলেন। কিন্তু কেন করিব, এ কথাটি ভুলিয়াও মনে উদয় হইল না! শাস্ত্রকারের—

কেবলং শাস্ত্রমাশ্রিত্য ন কর্ত্তব্যো বিনির্ণয়ঃ।
যুক্তিহীনে বিচারে তু ধর্ম্মহানিঃ প্রজায়তে॥

 এই অমূল্য উপদেশ অনুসারে চলিবার ইচ্ছা বা সাহস কাহারও রহিল না। সুতরাং এই দুর্দ্দিনে দুই শ্রেণীর লোকের আধিপত্য বিস্তার হইল। এক শ্রেণী শাস্ত্রকার, অপর শ্রেণী শাস্ত্রব্যাখ্যাতা। স্বাধীন চিন্তার তিরোধানের সঙ্গে সঙ্গে মৌলিকতা (Originality) চলিয়া গেল, সুতরাং বুদ্ধিবৃত্তি ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধ হইয়া ঋষিবাক্যের অর্থ লইয়া অযথা গণ্ডগোলে ব্যাপৃত হইল। ইহাই টীকা টিপ্পনীর প্রারম্ভ। আবার শ্রুতি ও স্মৃতিতে বিষম বিরোধ উপস্থিত হইল। শ্রুতি প্রামাণ্য এই উক্তিও ঐ সময়ে প্রকটিত হইল। সমাজ যখন এই অবস্থায় পতিত হয়, তখন আবার আর এক প্রকার বিপদ আসিয়া সম্মুখীন হয়। নিজের উদ্যমশীলতার ও নিজের কৃতকর্ম্মতার উপর ঘোর অবিশ্বাস জন্মে, অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক ব্যাপারসমূহের উপর ততই অচল বিশ্বাস আসিয়া দাঁড়ায়। “আমি কিছুই করিতে পারি না, আমাকে কিছুই করিতে হইবে না, মায়ের কাছে জোড়া মহিষ মানিব, পীর পৈগম্বরের দরগায় সোয়া পাঁচ আনার সিন্নি দিব, আর আমার অভীষ্ট সিদ্ধ হইবে,” ইত্যাকার বিশ্বাস আসিয়া দুর্ব্বলচিত্ত মানবকে আশ্রয় করে। স্বাধীন চিন্তা বিসর্জ্জনের ইহাই সর্ব্বশেষ অধ্যায়। পীড়া হইলে ঔষধ সেবনের প্রয়োজন নাই, “জলপড়া” পান করিলেই চলিবে, মৃতপীরের দীর্ণ