জানুয়ারী মাসে পনর দিন ধরিয়া ক্রমাগত বৃষ্টি হইল। তাহার ফলে হাড়ের সংলগ্ন মাংস পচিয়া দুর্গন্ধ বিকীর্ণ করিতে লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে সেই পচা মাংসে সূতার মত পোকা দেখা দিল। সন্ধান পাইয়া ঝাঁকে ঝাঁকে কাকের দল আমার গৃহ আক্রমণ করিল এবং মনের আনন্দে পচা মাংস ও পোকা ভোজন করিতে লাগিল এবং হাড়গুলি টানাটানি করিয়া আমার প্রতিবাসীদের গৃহেও ছড়াইতে লাগিল। আমার বাড়ীর চারিদিকেই নিষ্ঠাবান হিন্দুদের বাস। তাঁহারা সানুনয়ে আমাকে হাড়গুলি অন্যত্র সরাইতে বলিলেন। এমন আভাষও দিলেন যে, আমি স্বেচ্ছায় না সরাইলে তাঁহারা করপোরেশনের হেল্থ অফিসারের সাহায্য গ্রহণ করিবেন। সতরাং হাড়গুলি আমাকে তৎক্ষণাৎ সরাইবার ব্যবস্থা করিতে হইল। সৌভাগ্যক্রমে, আমার পরিচিত একজন নাইট্রিক অ্যাসিড ব্যবসায়ী আমার সাহায্যার্থ অগ্রসর হইলেন। মুরারিপুকুরের[১] নিকট মানিকতলায় তিনি একখণ্ড জমি ইজারা লইয়াছিলেন। আমাকে হাড়গুলি সেই স্থানে পাঠাইয়া দিতে বলিলেন। হাড়গুলি সেখানে পাঠাইয়া দেওয়া হইল, এবং ইঁটের পাঁজার মত স্তুপাকার করিয়া তাহাতে অগ্নি সংযোগ করা হইল। মধ্যরাত্রিতে সেই হাড়ের স্তুপ জ্বলিয়া উঠিল। স্থানীয় বিটের পুলিশ ব্যাপার সন্দেহজনক মনে করিয়া “ইয়া ক্যা লাস জলতা হ্যা” বলিতে বলিতে দৌড়াইয়া আসিল। তাহার ভ্রম দূরে করিবার জন্য একটা লম্বা বাঁশ দিয়া ভিতর হইতে কতকগুলি হাড় টানিয়া বাহির করিয়া তাহাকে দেখানো হইল। পুলিশ কনেষ্টবল সন্তুষ্ট হইয়া চলিয়া গেল। হাড়ের ভস্ম এখন কাজে লাগানো হইল। সালফিউরিক অ্যাসিড যোগে উহা সুপার ফস্ফেট অব লাইমে পরিণত হইল এবং তাহার পর সোডার প্রতিক্রিয়ায় ফস্ফেট অব সোডা হইল।
ছাত্রদিগকে আমার অধ্যাপনার প্রণালী সম্বন্ধে এইখানে একটু বলিব। আমি টেবিলের উপরে পোড়ানো হাড়ের গুঁড়ার নমুনা রাখিতাম। যে উপকরণ হইতে ইহা প্রস্তুত তাহার সঙ্গে এখন আর কোন সম্বন্ধ নাই। গরু, ঘোড়া অথবা মানুষের কঙ্কাল হইতেও উহার উৎপত্তি হইতে পারিত। হাড় ভস্ম রাসায়নিক হিসাবে বিশুদ্ধ মিশ্রপদার্থ, রাসায়নিকদের নিকট ইহা “ফস্ফেট অব ক্যালসিয়ম” এবং চূর্ণ আকারে ইহা স্নায়বিক শক্তিবর্ধক ঔষধরূপে ব্যবহৃত হয়; আমি অনেক সময় খানিকটা হাড়ভস্ম আমার মুখে ফেলিয়া দিতাম এবং চিবাইয়া গিলিয়া ফেলিতাম এবং ছাত্রদেরও তাহাই করিতে বলিতাম। কেহ কেহ বিনা দ্বিধায় আমার অনুকরণ করিত; কিন্তু অন্য কেহ কেহ আবার ইতস্ততঃ করিত, তাহাদের মন হইতে গোঁড়ামির ভাব দূর হইত না। অল্পদিন পূর্বে আমার একজন ভূতপূর্ব ছাত্রের সঙ্গে দেখা হইয়াছিল। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র এবং এখন মাড়োয়ারী সমাজের অলঙ্কার, রাজনীতিক, অর্থনীতিবিৎ এবং ব্যবসায়ী হিসাবে খ্যাতনামা। তিনি হাসিতে হাসিতে কলেজ জীবনের এই পুরাতন কথা আমাকে স্মরণ করাইয়া দিলেন (শ্রীযুক্ত দেবীপ্রসাদ খৈতান)।
যে সমস্ত রাসায়নিক দ্রব্য বিদেশ হইতে আমদানী হয়, তাহার কতকগুলি এই দেশেই প্রস্তুত করিবার সমস্যা সমাধান করিয়া, আমি ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়ার ঔষধ তৈয়ারীর দিকে মনোযোগ দিলাম। Syrup Ferri Iodidi, Liquor Arsenicalis প্রভৃতি কতকগুলি ঔষধ প্রস্তুত করা একজন শিক্ষিত রাসায়নিকের পক্ষে শক্ত নহে, ইহা দেখিয়া আমি আশ্বস্ত হইলাম। ইথার তৈয়ারী করিতেও আমি প্রবৃত্ত হইলাম। কিন্তু ঐ কার্য করিতে করিতে ভীষণ বিস্ফোরণে কাচপাত্র ভাঙিয়া চুরমার হইল দেখিয়া আমি সতর্ক
- ↑ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের যুগে বিপ্লবীদের বোমার কারখানা ছিল বলিয়া মুরারিপুকুর প্রসিদ্ধ হইয়াছে।