পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
৬৭

হইলাম। বাজারের সোরাকেও বিশুদ্ধ করিয়া পটাস নাইট্রস বি, পি, তে পরিণত করা গেল।

 পুরাতন বোতল, শিশি প্রভৃতি বহুবাজারের বিক্রীওয়ালাদের নিকট হইতে যত ইচ্ছা সংগ্রহ করা যায়, আমি তাহাদের গুদাম পরীক্ষা করিতে আরম্ভ করিলাম। আমার প্রয়োজনের মত জিনিস যে এখান হইতেই সংগ্রহ করা যাইবে, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত হইলাম।

 এই সমস্ত গোড়ার কথা ঠিক করিয়া একটা ঔষধের কারখানা খুলিবার জন্য আমি মনস্থ করিলাম। এই কারখানার কি নাম হইবে, তাহা লইয়া বহু চিন্তার পর অবশেষে বর্তমান নামটি (বেঙ্গল কেমিক্যাল এণ্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস) দেওয়াই স্থির করিলাম। নামটি একটু লম্বা, কিন্তু রাসায়নিক ও ভেষজ উভয় প্রকার পদার্থের পরিচয়ই নামের মধ্যে থাকা চাই, ইহাই আমার ইচ্ছা ছিল। নামটি যে ঠিকই হইয়াছিল, তাহা সময়ে প্রমাণিত হইয়াছে। অন্ততঃপক্ষে এই নামের সম্বন্ধে কেহ কোন আপত্তি করে নাই।

 এখন আমার প্রস্তুত ঔষধাদি বাজারে কিরূপে চালানো যায়, সেই চিন্তা করিতে লাগিলাম। আমি একজনকে ‘দালালের’ কাজে শিক্ষিত করিয়া তুলিয়াছিলাম। সে আমার ঔষধ তৈয়ারীর জন্য কাঁচামাল কিনিত এবং আমার প্রস্তুত দ্রব্য বাজারে বিক্রয় করিত। একটী যুবক আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতার (ডাক্তার) নিকট কম্পাউণ্ডারের কাজ করিত। বর্তমানে সে বসিয়া ছিল। আমি তাহাকে গ্রাম হইতে লইয়া আসিলাম। ডিস্‌পেন্সারিতে যে সব সাধারণ ঔষধ ব্যবহৃত হয়, সেগগুলির নাম সে জানিত। তাহার নিকট আমি আমার ঔষধ তৈয়ারীর কল্পনার কথা বলিলাম। যুবকটি প্রাইমারি ষ্ট্যাণ্ডার্ড পর্যন্ত পড়িয়াছিল, লেখাপড়া সামান্য শিখিয়াছিল,—ইংরাজীও কিঞ্চিৎ জানিত। তাহার দ্বারা আমার কাজ বেশ চলিতে লাগিল। তখনকার দিনে ম্যাট্রিক পাশ ছেলে বেশি ছিল না, যাহারা ইংরাজী স্কুলের উচ্চ শ্রেণী পর্যন্ত পড়িত, অথবা দুর্ভাগ্যক্রমে কোন কলেজের দরজা পার হইত, তাহাদের একটা ভ্রান্ত মর্যাদাজ্ঞান জন্মিত এবং এই জাতিভেদের দেশে, তাহাদের মনে এক নূতন জাত্যভিমানের সৃষ্টি হইত। আমার নির্বাচিত যুবকটির এসব দোষ ছিল না। সে আমার সঙ্গেই থাকিত এবং সামান্য পারিশ্রমিক লইত। তবে জিনিস বিক্রয়ের উপর তাহাকে কিছু কমিশন দিব বলিয়াছিলাম। সে তরুণবয়স্ক, সুতরাং তাহার মধ্যে উৎসাহ বা আদর্শবাদের অভাব ছিল না। আমার মনের ছোঁয়াচও তাহার লাগিয়াছিল। লোহার উপর সালফিউরিক অ্যাসিডের প্রতিক্রিয়ায় সবজে রঙের দানাদার ফেরি সালফ (বি, পি,) হইতে দেখিয়া সে একদিন উচ্ছসিতভাবে বলিয়াছিল—“ভগবান, কি আশ্চর্য এই রসায়ন বিজ্ঞান!” আবার দুর্গন্ধধময় গলিত হাড় হইতে সোডি ফস্‌ফ (বি, পি,) এর উদ্ভব দেখিয়া সে ভয়ে এ বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া গিয়াছিল। আমার প্রস্তুত ঔষধগুলি ইউরোপীয় কায়দায় বোতলে পুরিয়া লেবেল আঁটা ও প্যাক করা হইত। সেগুলি লইয়া আমার দালাল এখন ঔষধের বাজারে ঘুরিতে লাগিল।

 স্থানীয় ঔষধবিক্রেতাগণের সাধারণত রসায়নশাস্ত্রে কোন জ্ঞান নাই। তাহারা বড়জোর হিসাব করিয়া ব্যবসায়ে লাভ ক্ষতি গণনা করিতে পারে। তাহারা আমার প্রস্তুত ঔষধ দেখিয়া প্রশংসা করিল, কিন্তু মাথা নাড়িয়া বলিল,—“বড় বড় নামজাদা বিলাতি ফার্মের ঔষধ সহজেই বিক্রয় হয়, কিন্তু দেশি ঔষধ লোকে চায় না।” সতরাং গোড়া হইতেই আমাদিগকে কঠোর সংগ্রাম করিতে হইয়াছে।

 এই সময় এমন একটা ঘটনা ঘটিল, যাহা কেবল যে আমার প্রচেষ্টার নূতন শক্তি সঞ্চার করিল তাহা নহে,—আমাদের ব্যবসায়ের উপরও উহার ফল বহুদূরপ্রসারী হইল।