পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৮
আত্মচরিত

 একদিন আমার এক পুরাতন সতীর্থ আমার এই নূতন প্রচেষ্টার কথা শুনিয়া আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে আসিলেন। তাঁহার মনে খুব স্বদেশানুরাগ ছিল এবং তিনি উপলব্ধি করিতে পারিয়াছিলেন যে, আমাদের যুবকদের জন্য যদি নূতন নূতন জীবিকার পথ উন্মুক্ত না হয়, তবে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে বেকারসমস্যা প্রবল হইয়া আর্থিক ধ্বংস ও জাতীয় দুর্গতি আনয়ন করিবে। ইনিই ডাঃ অমূল্যচরণ বসু। চিকিৎসা ব্যবসায়ে তিনি তখন বেশ সাফল্যলাভ করিয়াছেন এবং এই সময় হইতে আমাদের নূতন ব্যবসায়ে যোগ দিয়া তিনি অনেক কাজ করিয়াছিলেন। আমি তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে ভিতরের দিকের ঘরে লইয়া গেলাম, যেখানে বড় বড় কটাহ ও ভাটিতে ফেরি সাল্‌ফ, সোডি ফস্‌ফ এবং অন্যান্য কয়েকটি রাসায়নিক দ্রব্য দানা বাঁধিতেছিল। আমার নূতন ব্যবসায়ের প্ল্যান আমি তাঁহাকে বলিলাম এবং তাহা যে সম্ভবপর তাহাও বুঝাইয়া দিলাম। অমূল্যচরণ উৎসাহী লোক ছিলেন। তিনি আমার কথায় আনন্দে নৃত্য করিতে লাগিলেন এবং সাগ্রহে আমার সঙ্গে যোগ দিলেন।

 তাঁহার সহযোগিতা আমাদের পক্ষে খুবই মূল্যবান হইল। তিনি যে কেবল ব্যবসায়ে মূলধন হিসাবে আর্থিক সাহায্যই করিলেন তাহা নয়, আমাদের প্রস্তুত ঔষধগুলি যাহাতে ডাক্তারদের সহানভূতি লাভ করিতে পারে, তাহার জন্যও চেষ্টা করিতে লাগিলেন। সোদপুরের অ্যাসিডের কারখানা যাদব মিত্র লাভজনক ব্যবসারূপে চালাইতে পারিলেন না, কেন না যে লোকটির উপর তিনি এই কারখানার ভার দিয়াছিলেন, তাহার বেতন অতি সামান্য ছিল, কাজও সে কিছু বুঝিত না। যাদব মিত্র এক হাজার টাকায় আমাকে এই কারখানা বিক্রয় করিতে চাহিলেন। কিন্তু টাকা কোথায় পাওয়া যায়? তিন বৎসর চাকরী করিয়া ব্যাঙ্কে আমার ৮০০ টাকা জমিয়াছিল, সে টাকা গোড়ার দিকে পরীক্ষার কাজেই ব্যয় হইয়া গিয়াছিল। মিত্র আমার আর্থিক অবস্থা ভালই জানিতেন। আমি যদি টাকার জন্য হ্যাণ্ডনোট লিখিয়া দিই তাহা হইলেই তিনি কারখানা ছাড়িয়া দিতে রাজী হইলেন। দুই এক মাস পরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিযুক্ত পরীক্ষক হিসাবে আমার প্রায় ছয় শত টাকা পাওয়ার কথা। অবশিষ্ট টাকা আমি কয়েক কিস্তিতে শোধ করিতে পারিব। এই সমস্ত ভাবিয়া আমি মিত্রের প্রস্তাবে সম্মত হইয়া চুক্তি পাকা করিলাম এবং তৎক্ষণাৎ অ্যাসিডের কারখানার দখল লইলাম। কিন্তু আর একটা নূতন বাধা উপস্থিত হইল। আমার বাসস্থান হইতে এই কারখানা ছয় মাইল দূরে, স্থানটিও সুগম নয়। সুতরাং কারখানার কাজ কিরূপে চালানো যাইবে। চন্দ্রভূষণ ভাদুড়ীরও এ বিষয়ে উৎসাহ ছিল, আমি তাঁহার সঙ্গে পরামর্শ করিলাম। তিনি আমার সঙ্গে একমত হইলেন। ১৮৯৩ সালের গ্রীষ্মের ছুটী কেবল আরম্ভ হইয়াছে, মে ও জুন এই দুই মাস ছুটী। চন্দ্রভূষণ, তাঁহার ভ্রাতা কুলভূষণ এবং তাঁহাদের একজন আত্মীয়, সোদপুরের এই দুর্গম স্থানে গেলেন। যেখানে তাঁহারা বাসা লইলেন সে একটা মাটির কুটীর। নিকটে কোন বাজার ছিল না, কোন মাছ তরকারিও পাওয়ার উপায় ছিল না। সতরাং তাঁহাদিগকে কয়েক বস্তা চাল এবং আলু সংগ্রহ করিয়া লইয়া যাইতে হইয়াছিল। এই দিয়া বাঁশবনে তাঁহারা মহানন্দে চড়ুইভাতি করিতে লাগিলেন। তাঁহারা অ্যাসিডের ঘরগুলি উত্তমরূপে পরীক্ষা করিলেন এবং এই ‘আদিম’ প্রণালীতে কার্য করাতে কাঁচামালের যে পরিমাণ অপচয় হইতেছে, তাহা দেখিয়া দঃখিত হইলেন। এইরূপে একটি ছোট কারখানা যদি কোন মূলধনী নিজে চালায় এবং সমস্ত খুটিনাটি দেখাশুনা করে, তাহা হইলে লাভজনক হইতে পারে। কিন্তু কোন শিক্ষিত রাসায়নিকের এরূপ স্থানে কোন কাজ নাই।