ভাদুড়ীভ্রাতাগণ জুলাই মাসে কলেজ খুলিতেই সোদপুর হইতে চলিয়া আসিলেন। কিন্তু কিরূপে আধুনিক প্রণালীতে একটি অ্যাসিডের কারখানা স্থাপন করা যায়, তৎসম্বন্ধে তাঁহারা রিপোর্ট আমাকে দিলেন। কিন্তু তখনও ঐরূপ কোন কারখানা স্থাপনের সময় হয় নাই। আমি প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহ করিতে পারিলাম না এবং ঔষধ প্রস্তুতের দিকেই আমাকে সমস্ত অবসর সময় ব্যয় করিতে হইত। ইহার দশ বৎসর পরে বৃহদাকারে কেমিক্যাল ও ফার্মাসিউটিক্যাল কারখানা কার্যে পরিণত করা হইল। তাহার সঙ্গে একটি অ্যাসিড তৈরীর বিভাগও যুক্ত হইল।
ইতিমধ্যে আমি ঔষধ প্রস্তুতের কাজে ডুবিয়া গেলাম। ‘ফার্মাসিউটিক্যাল জার্নাল’, ‘কেমিষ্ট এণ্ড ড্রাগিষ্ট’ প্রভৃতি সাময়িক পত্র হইতে এই বিষয়ে খুব সাহায্য পাওয়া যাইত। আমার নিজের চেষ্টাতেই নানা কঠিন সমস্যার সমাধান করিতে হইত। একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি। আমি যে সিরাপ অব আইওডাইড অব আয়রন প্রস্তুত করিতাম তাহা কিছুদিন রাখিলে ঈষৎ পীতাভ হইত। বিলাত হইতে যে ঔষধ আমদানী হইত তাহাতে অনেকদিন পর্যন্ত ঈষৎ সবজে রং থাকিত। কিরূপে এই সমস্যার সমাধান করা যায়? একদিন পূর্বোক্ত সাময়িক পত্রগুলি উল্টাইতে উল্টাইতে আমি ইহার সমাধানের পন্থা খুঁজিয়া পাইলাম। ফেরাস আইওডাইড প্রস্তুত হইলে, তাহার সঙ্গে একট, হাইপো ফস্ফরাস অ্যাসিড যোগ করিলেই উহাতে যতদিন ইচ্ছা ঈষৎ সবুজ রং থাকিবে। এইরূপে আমি ঔষধ প্রস্তুতের কাজে অভিজ্ঞতা লাভ করিতাম এবং কোন সমস্যা উপস্থিত হইলে, তাহার সমাধানে তৎপর হইতাম।
এই সময়ে আমাদের জিনিস বাজারে বেশ চলিতে আরম্ভ করিল, এবং স্থানীয় ঔষধ বিক্রেতাদের আলমারিতে স্থান পাইল। প্রথম প্রথম ঔষধের নমুনা লইয়া যাওয়া মাত্র অনেকে আমাদের বিরুদ্ধতা করিতেন, আমাদের কাজের সম্বন্ধে শ্লেষ বিদ্রূপ করিতেন। তাঁহাদের মধ্যে কাহারও কাহারও এখন মত পরিবর্তন হইতে লাগিল এবং তাঁহারা আমাদের তৈয়ারী জিনিসের প্রশংসা করিতে লাগিলেন। কিন্তু তবু তাঁহারা তাঁহাদের গ্রাহকদের এই বলিয়া নিন্দা করিতে ত্রুটি করিতেন না যে, তাঁহাদের দেশি জিনিসের উপর আস্থা নাই। ইতিমধ্যে অমূল্যচরণ ডাক্তার-মহলে আমাদের জিনিসের জন্য খুব প্রচারকার্য করিতে লাগিলেন। একটা প্রবাদ আছে, “চোর ধরিবার জন্য চোরকেই লাগাও”। প্রবাদটির মূলে কিছু সত্য আছে। পরলোকগত রাধাগোবিন্দ কর, অমূল্যচরণ বসু, প্রভৃতিকে কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজের প্রবর্তকরূপে গণ্য করা যাইতে পারে। তাঁহাদিগকে আমাদের পক্ষে আনা কঠিন হইল না। তাঁহাদের সমব্যবসায়ী অন্যান্য উদীয়মান চিকিৎসকগণ—নীলরতন সরকার, সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারী প্রভৃতিও স্বদেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত হইয়া ক্রমে আমাদের প্রস্তুত এট্কিন্স্ সিরাপ, সিরাপ অব হাইপোফস্ফাইট অব লাইম, টনিক গ্লিসেরোফসফেট, প্যারিশ কেমিক্যাল ফুড প্রভৃতিও ব্যবহারের ব্যবস্থা দিতে লাগিলেন।
স্মরণাতীত কাল হইতে আমাদের কবিরাজেরা যে সব দেশি ভেষজ ব্যবহার করিয়া আসিতেছেন, অমূল্যচরণ ও রাধাগোবিন্দের সে সমস্তের উপর একটা সহজ আস্থা ও বিশ্বাস ছিল। যে সমস্ত ডাক্তারি ঔষধ প্রচলিত ছিল, আমি সেইগুলিই প্রস্তুত করিতে আরম্ভ করি, কিন্তু অমূল্যচরণ আমাদের ব্যবসায়ে নূতন পথ প্রদর্শন করিলেন। তিনি কয়েকজন কবিরাজের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া আয়ুর্বেদীয় ঔষধের প্রস্তুত প্রণালী সংগ্রহ করিলেন। কালমেঘের সার, কুচ্চির সার, বাসকের সিরাপ, জোয়ানের সার প্রভৃতি ভেষজের প্রস্তুত প্রণালী তিনি আমার নিকট উপস্থিত করিলেন। এতদ্ব্যতীত তিনি নিজে এই সমস্ত দেশীয় ভেষজের জন্য প্রচারকার্য করিতে লাগিলেন। ডাক্তারদিগকে তিনি বলিতেন