যে, এই সমস্ত ঔষধের গুণ বাংলার ঘরে ঘরে বহু বৎসরব্যাপী ব্যবহারের ফলে প্রমাণিত হইয়াছে। এখন কেবল আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে উহাদের ভেষজ শক্তিকে কাজে লাগাইতে হইবে এবং ডাক্তারদিগকে উহা ব্যবহার করিতে হইবে। অমূল্যচরণ নিজে ঐ সব দেশীয় ঔষধ ব্যবহার করিয়া পথ প্রদর্শন করিলেন। ধীরে ধীরে এই সব দেশীয় ঔষধের উপকারিতা স্বীকৃত হইতে লাগিল। তখনকার দিনে ‘টলুর সিরাপ’ ব্যবহার করা সর্বত্র প্রচলিত ছিল। কিন্তু দেখা গেল, বাসকের সিরাপ উহা অপেক্ষা অধিকতর ফলপ্রদ। আমাদের নবপ্রবর্তিত দেশীয় ভেষজ এইভাবে নিজের গুণেই সর্বত্র প্রচারিত হইতে লাগিল।
এস্থলে উল্লেখযোগ্য যে, ১৮৪১ সালে ও, সোগনেসী দেশীয় ভেষজ ব্যবহারের কথা বলেন; তারপর কানাইলাল দে, মদীন শেরিফ, উদয়চাঁদ দত্ত ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়ায় কতকগগুলি দেশীয় ভেষজ অন্তর্ভুক্ত করিবার জন্য বহু চেষ্টা করেন। অর্ধ শতাব্দী পরে ঐ সমস্ত চিকিৎসকগণের প্রস্তাবের প্রতি চিকিৎসকগণের মনোযোগ আকৃষ্ট হইল। ১৮৯৮ সালে কলিকাতায় ইণ্ডিয়ান মেডিক্যাল কংগ্রেসের যে অধিবেশন হইল, তাহাতে আমরা একটি ষ্টল খুলিয়া আমাদের প্রস্তুত দেশীয় ভেষজ প্রদর্শন করিয়াছিলাম। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ হইতে আগত ডাক্তারদের দৃষ্টি উহার প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হইল। ডাঃ কানাই লাল দে তখন মৃত্যুর দ্বারে অতিথি বলিলেও হয়। কিন্তু তাঁহারই অনুপ্রেরণায় মেডিক্যাল কংগ্রেসের কাউন্সিল কতকগুলি দেশীয় ভেষজকে গ্রহণ করিবার জন্য চিকিৎসক সঙ্ঘের নিকট আবেদন করিলেন। ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়ার কর্তারা অবশেষে সে আবেদন গ্রাহ্য করিলেন এবং দেশীয় ভেষজ ফার্মাকোপিয়ার ‘পরিশিষ্টে’ স্থান লাভ করিল।
বাজারে এখন আমরা প্রবেশ করিবার সুযোগ পাইলাম। পাইকারী ব্যবসায়ীরা আমাদের জিনিস সম্বন্ধে খোঁজ করিতে লাগিলেন। দেশি জিনিস প্রচলন করিবার বিরুদ্ধে একটা প্রধান বাধা ছিল এই যে, কলিকাতায় ঔষধের বাজার প্রধানত অশিক্ষিত স্থানীয় এবং পশ্চিমা মুসলমানদের হাতে ছিল। ইহাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র স্বদেশপ্রীতি ছিল না এবং ইহারা স্থানীয় ভেষজপ্রস্তুতকারকদের উপর অন্যায় সুবিধা গ্রহণ করিতে ছাড়িত না। ‘দেশি চিজ’এর বাজারে চাহিদা ছিল না, সুতরাং মূল্য না কমাইলে, তাহারা ঐ সব জিনিস বাজারে চালাইতে চাহিত না। মূল্য কমাইলেও, নগদ দাম তাহারা দিত না, নির্দিষ্ট কালের জন্য টাকা ফেলিয়া রাখিতে হইত। সৌভাগ্যক্রমে বাঙালীদের পরিচালিত দুই একটি ফার্ম প্রথম হইতেই আমাদের প্রস্তুত জিনিসের আদর করিতেন। একদিন আমরা বেশি পরিমাণে কতকগুলি কাঁচামাল খরিদ করিয়াছিলাম— যথা আইওডিন, টলু, বেলেডোনা প্রভৃতি। কলিকাতার প্রধান ঔষধ ব্যবসায়ী মেসার্স বটকৃষ্ণ পাল অ্যাণ্ড কোম্পানির পরলোকগত ভূতনাথ পাল, আমরা এত অধিক পরিমাণে আইওডিন কিনিতেছি দেখিয়া বিস্মিত হইলেন। আমরা ৭ পাউণ্ড আইওডিন কিনিয়াছিলাম। কলিকাতার বা মফঃস্বলের কোন সাধারণ ঔষধালয় মাসে, এমন কি বৎসরে এক পাউণ্ডের বেশি আইওডিন কিনিত না। ভূতনাথবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনারা একবারে এত বেশি আইওডিন কিনিয়া কি করিবেন?” আমরা যখন তাঁহাকে বুঝাইয়া দিলাম যে আইওডিন হইতে ‘সিরাপ ফেরি আইওডাইড’ প্রস্তুত হইবে, তখন তাঁহার কৌতূহল বর্ধিত হইল। তাঁহার কাছে আমাদের জিনিসের ‘অর্ডার’ দেওয়ার জন্য পূর্বেই অনুরোধ করা হইয়াছিল, কিন্তু তিনি উহাতে তেমন গুরুত্ব দান করেন নাই, কেন না স্বভাবতই আমাদের প্রচেষ্টার উপর তাঁহার বিশ্বাস জন্মে নাই, কিন্তু এখন তাঁহার চোখ খুলিল। ৭ পাউণ্ড আইওডিন এবং টলু প্রভৃতির দ্বারা ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়ার ঔষধ তৈরারী হইবে, ব্যাপারটা তুচ্ছ নয়! পাল