পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
৭১

তৎক্ষণাৎ এক হন্দর সিরাপ ফেরি আইওডাইডের জন্য অর্ডার দিলেন এবং আমার যতদূর স্মরণ হয়, এক হন্দর ফেরি সাল্‌ফের জন্যও তিনি অর্ডার দিয়াছিলেন।

 যখন আমার হাতে এই অর্ডার আসিল, আমার আনন্দের আর সীমা রহিল না। কলেজ হইতে ফিরিয়া প্রত্যহ অপরাহ্ণে (প্রায় ৪॥০টার সময়) আমি পূর্বদিনের প্রাপ্ত অর্ডারগুলি দেখিতাম এবং যাহাতে ঐ সব জিনিস শীঘ্র সরবরাহ হয় তাহার ব্যবস্থা করিতাম। কলেজ লেবরেটরী হইতে আমার ফার্মেসীর লেবরেটরীতে যাওয়া আমার পক্ষে বিশ্রামের মতই ছিল। আমি তৎক্ষণাৎ আমার নূতন কাজে প্রবৃত্ত হইতাম এবং অপরাহ্ণ ৪॥০টা হইতে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খাটিয়া কাজ শেষ করিতাম। কাজের সঙ্গে আনন্দ থাকিলে তাহাতে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় না। যে সমস্ত ঔষধ বিদেশ হইতে আমদানী হইত, তাহাই এদেশে প্রস্তুত করিতে পারিতেছি, এই ধারণাই আমার মনে বল দিত। সিরাপ ফেরি আইওডাইড, স্পিরিট অব নাইট্রিক ইথর, টিংচার অব নক্সভমিকা প্রভৃতি প্রকৃতপক্ষে লেবরেটরীতে তৈরী হয়, কেন না ঐগুলি প্রস্তুত করিতে শিক্ষিত রাসায়নিকের প্রয়োজন। প্রত্যেকটি নমুনার জন্য গ্যারাণ্টি দিতে হইবে, ইহার জন্য বিশ্লেষণের ক্ষমতা চাই।

 এই সময় আমার পক্ষে একটা বিষম অনর্থপাত হইল। অমূল্যের ভগ্নীপতি সতীশচন্দ্র সিংহ রসায়ন শাস্ত্রে এম, এ, পাশ করিয়া আইনের পড়াও শেষ করে। মামুলী প্রথায় আইন পরীক্ষায় পাশ করিয়া সে হয়ত ওকালতী আরম্ভ করিত। কিন্তু অমূল্যের আদর্শে তাহার চিত্ত অনুপ্রাণিত হইল, সে নিজের রাসায়নিক জ্ঞান কাজে লাগাইতে ইচ্ছুক হইল এবং এই উদ্দেশ্যে আমাদের নূতন ব্যবসায়ে যোগ দিল। একটা নূতন ব্যবসায়, ভবিষ্যতে যাহার দ্বারা বিশেষ কিছু লাভের আশা নাই, তাহার কাজে এইভাবে আত্মোৎসর্গ করা কম আত্মবিশ্বাস ও সৎসাহসের পরিচায়ক নহে। এরূপ কাজে কঠোর পরিশ্রমের জন্য প্রস্তুত হইতে হয় এবং কিছু কালের জন্য লাভের কোন আশাও মন হইতে দূর করিতে হয়। যুবক সতীশ আমার একজন প্রধান সহকারী হইল, সে কিছু মূলধনও ব্যবসায়ে দিয়াছিল। রাসায়নিক কাজে এ পর্যন্ত বলিতে গেলে আমি এককই ছিলাম এবং আমার পক্ষে অত্যন্ত বেশী পরিশ্রমও হইত। তাছাড়া যে অবসর সময়টুকুতে আমি অধ্যয়ন করিতাম, তাহাও লোপ হইয়াছিল, আমি সতীশকে আমার উদ্ভাবিত নূতন প্রণালীর রহস্য বুঝাইতে লাগিলাম এবং সে শিক্ষিত রাসায়নিক বলিয়া শীঘ্রই এ কাজে পটুতা লাভ করিল। আমরা দুইজন একসঙ্গে প্রায় দেড় বৎসর উৎসাহসহকারে কাজ করিলাম এবং আমাদের প্রস্তুত বহু দ্রব্যের বাজারে বেশ চাহিদা হইল। কোন কোন চিকিৎসক তাঁহাদের ব্যবস্থাপত্রে যতদূর সম্ভব আমাদের ঔষধ ব্যবহার করিতে লাগিলেন। কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা আমাকে ভীষণ অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়া উত্তীর্ণ হইতে হইবে। একদিন বৈকালে আমি অভ্যাসমত ভ্রমণে বাহির হইয়াছিলাম। রাত্রি ৮॥টার সময় বাড়ী ফিরিয়া শুনিলাম, সতীশ আর নাই। বজ্রাঘাতের মতই এই সংবাদে আমি মুহ্যমান হইলাম। দৈবক্রমে হাইড্রোসায়ানিক অ্যাসিড বিষে তাহার মৃত্যু হইয়াছে। আমি প্রায় জ্ঞানশূন্যে অবস্থায় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দিকে ছুটিলাম। সেখানে সতীশের মৃতদেহ স্ট্রেচারের উপরে দেখিলাম। আমি নিশ্চল প্রস্তরমূর্তির মত বাহ্যজ্ঞান শূন্য হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম—বহুক্ষণ পরে প্রকৃত অবস্থা আমি উপলব্ধি করিতে পারিলাম। এই তরুণ যুবক জীবনের আরম্ভেই কালগ্রাসে পতিত হইল, পশ্চাতে রাখিয়া গেল তাহার শোকসন্তপ্ত বৃদ্ধ পিতামাতা এবং তরুণী বিধবা পত্নী। অমূল্য ও আমার মানসিক যন্ত্রণা বর্ণনার ভাষা নাই। আমাদের বোধ হইল, আমরাই যেন সতীশের মৃত্যুর কারণ। সেই ভীষণ দুর্ঘটনার