পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭৬
আত্মচরিত

প্রেসিডেন্সি কলেজে ভূতত্ত্বের লেকচারার ছিলেন। তিনি অনগ্রহপূর্বক কতকগুলি ধাতুর নমুনা আমাকে দিতে চাহিলেন। আমি এই বিষয়ে নূতন গবেষণা আরম্ভ করিলাম। Crookes’ Select Methods in Chemical Analysis সেই সময়ে প্রামান্য গ্রন্থ ছিল এবং তাহারই অনুসরণ করিয়া আমি গবেষণা করিতে লাগিলাম। আমি গবেষণা কার্যে কিছুদূর অগ্রসর হইয়াছি, এমন সময় আমার রাসায়নিক জীবনে এক অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন ঘটিল।

 মার্কিউরাস্ নাইট্রাইটের আবিষ্কার দ্বারা আমার জীবনে এক নূতন অধ্যায়ের সূত্রপাত হইল। যেরূপ অবস্থায় এই আবিষ্কার হইল, তাহা এ বিষয়ে প্রকাশিত প্রথম বিবৃতির ভূমিকা হইতে উদ্ধৃত করিতেছি:—

 “সম্প্রতি পারদের উপর অ্যাসিডের ক্রিয়ার দ্বারা মার্কিউরাস নাইট্রেট প্রস্তুত করিতে গিয়া, আমি নীচে এক প্রকার পীতবর্ণের দানা পড়িতে দেখিয়া কিয়ৎ পরিমাণে বিস্মিত হইলাম। প্রথম দৃষ্টিতে ইহা কোন ‘বেসিক সল্ট’ বলিয়া মনে হইল। কিন্তু এরপ প্রক্রিয়া দ্বারা ঐ শ্রেণীর ‘সল্টের’ উৎপত্তি সাধারণ অভিজ্ঞতার বিপরীত। যাহা হউক, প্রাথমিক পরীক্ষা দ্বারা ইহা মার্কিউরাস সল্ট এবং নাইট্রাইট উভয়ই প্রমাণিত হইল। সুতরাং এই নূতন মিশ্র পদার্থ গবেষণার যোগ্য বিষয় মনে হইতেছে।”

 মার্কিউরাস নাইট্রাইট ও তাহার আনুষঙ্গিক বহুসংখ্যক পদার্থ এবং সাধারণ ভাবে মার্কিউরাস নাইট্রাইট সম্বন্ধে গবেষণার প্রকৃত বিবরণ দেওয়ার প্রয়োজন এখানে নাই, কেন না তৎসম্বন্ধে শতাধিক নিবন্ধ রসায়নশাস্ত্র সম্বন্ধীয় সাময়িক পত্র সমূহে প্রকাশিত হইয়াছে। একটির পর একটি নূতন মিশ্র পদার্থ আবিষ্কৃত হইতে লাগিল, আর আমি অসীম উৎসাহে তাহা লইয়া পরীক্ষা করিতে লাগিলাম। নব্য রসায়নী বিদ্যার অন্যতম প্রবর্তক অমরকীর্তি শীলের ভাষায় আমিও বলিতে পারিতাম—“গবেষণা হইতে যে আনন্দ হয়, তাহার তুলনা নাই, ইহা হৃদয়কে উৎফুল্ল করে।” এই নবোন্মুক্ত গবেষণার ক্ষেত্রে বিচরণ করা এবং তাহার অজ্ঞাত স্থান সমূহ আবিষ্কার করা, ইহাতে প্রতি মুহূর্তেই মনে উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঞ্চার হইত। শিকারীরা জানেন যে শিকারকে হাতের মধ্যে পাওয়ার চেয়ে শিকারের অনুসরণ করাতেই অধিক আনন্দ। রস্কো, ডাইভার্স, বার্থেলো, ভিক্টর মেয়ার, ফলহার্ড এবং অন্যান্য বিখ্যাত রাসায়নিকদের নিকট হইতে প্রাপ্ত সম্বর্ধনাজ্ঞাপক পত্রাবলী আমার মনে যে কেবল উৎসাহের সঞ্চার করিল তাহা নহে, আমার কর্মেও অধিকতর প্রেরণা দান করিল।

 এই সময়ে অধ্যয়ন ও লেবরেটরিতে গবেষণা—এই দুইভাগে আমি আমার সময়কে বণ্টন করিয়া লইলাম। বেঙ্গল কেমিক্যাল ওয়ার্কসের জন্যও কতকটা সময় নির্দিষ্ট থাকিল। অনিদ্রা রোগের জন্য, আমাকে অধ্যয়ন স্পৃহা সংযত করিতে হইত। গত ৪৫ বৎসরের মধ্যে সন্ধ্যার পর আলোতে আমি কোন পড়ানো বা মানসিক পরিশ্রমের কার্য করিতে পারি নাই। এইরূপ কোন চেষ্টা করিলেই তাহার ফলে আমাকে অনিদ্রায় কাটাইতে হইত। “সকাল সকাল শয়ন করা ও সকাল সকাল ওঠা” এই নিয়ম আমি চিরদিন পালন করিয়াছি এবং আমার অভিজ্ঞতায় আমি দেখিয়াছি যে, সকাল বেলা একঘণ্টা অধ্যয়ন সন্ধ্যার পর বা রাত্রিকালে দুইঘণ্টা বা ততোধিক সময় অধ্যয়নের তুল্য; বিশেষতঃ যাহাকে দিনের অধিকাংশ সময় রুদ্ধবায়ু লেবরেটরিতে কাটাইতে হয় স্বাস্থ্যরক্ষার্থ তাহার পক্ষে প্রত্যহ অন্ততঃ দুইঘণ্টাকাল খোলাবাতাসে থাকা উচিত। শীত প্রধান দেশে অবস্থা বিশেষে এই নিয়মের অবশ্য পরিবর্তন করিতে হইবে। এডিনবারা বা লণ্ডনে শীতকালে সন্ধ্যার সময় দুই ঘণ্টাকাল লঘু সাহিত্য পাঠ করা আমার পক্ষে কিছুই ক্ষতিকর হইত না।