পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
৭৭

 এই সময়ে আমি আমার প্রিয় বিষয় রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাস এবং প্রসিদ্ধ রসায়নাচার্যদের জীবনী সম্বন্ধে আলোচনা করিতেছিলাম। কপের “ইতিহাস” দূরূহ গ্রন্থ, ইহার কঠিন সমাসযুক্ত লম্বা লম্বা পদগুলি পাঠ করা সুখকর নহে, কিন্তু বিষয়টি এমনই চিত্তাকর্ষক যে আমি ঐ গ্রন্থ নিয়মিত ভাবে পড়িতাম। আমি আমার মূল্যবান সকাল বেলা এই গ্রন্থ পাঠে ব্যয় করিতাম। আমি বেশ জানিতাম, আমাদের কবিরাজগণ বহু ধাতব ঔষধ ব্যবহার করিতেন; উদয়চাঁদ দত্তের Materia Medica of the Hindus নামক গ্রন্থে ইহার বিবরণ আছে। এই গ্রন্থে যে সমস্ত মূল সংস্কৃত গ্রন্থের নাম করা হইয়াছে, আমি কৌতূহলের বশবর্তী হইয়া তাহার কয়েকখানি পড়িলাম। প্রেসিডেন্সি কলেজ়ের লাইব্রেরিতে প্রাপ্ত Berthelot’s L’Alchimistes Grecs নামক গ্রন্থও পড়িলাম। তাহাতে আমার কৌতূহল আরও বর্ধিত হইল। এই সময়ে উক্ত প্রসিদ্ধ ফরাসী রাসায়নিক বার্থেলোর সঙ্গেই আমার পত্র ব্যবহার হইল। আমি তাঁহাকে লিখিয়াছিলাম, তিনি বোধ হয় জানেন না যে, প্রাচীন ভারতবর্ষেও ‘আলকেমী’ শাস্ত্রের বিশেষ চর্চা হইত এবং এ বিষয়ে সংস্কৃতে বহু গ্রন্থ আছে। তিনি আমাকে যে উত্তর দেন, তাহা তাঁহারই যোগ্য। আমি নিম্নে ঐ পত্রের অংশ বিশেষের ইংরাজী অনুবাদ দিলাম।[] বড়ই দঃখের বিষয় এই সময়ে বহু প্রসিদ্ধ রসায়নবিদের নিকট হইতে আমি যে সব পত্র পাইয়াছিলাম, তাহা রক্ষা করি নাই। বার্থেলোর পত্রখানি ঘটনাক্রমে নষ্ট হয় নাই। প্রেসিডেন্সি কলেজে আমার বিশ্রামগৃহে জঞ্জালাধারে কতকগুলি কাগজ আমার চোখে পড়ে। উহারই মধ্যে বার্থেলোর পত্র ছিল।

 এই পত্র আমার মনের উপর অসীম প্রভাব বিস্তার করিল। এই একজন শীর্ষস্থানীয় রসায়নবিৎ জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হইয়াছেন, অথচ যৌবনের উৎসাহে রসায়ন বিজ্ঞানের ইতিহাসের একটি নূতন অধ্যায় সম্বন্ধে জ্ঞান লাভের জন্য আগ্রহান্বিত, আর আমি যুবক হইয়াও যথোচিত উৎসাহ সহকারে কাজে অগ্রসর হইতে পারিতেছি না! আমার শরীরে যেন বিদ্যুৎপ্রবাহ বহিয়া গেল এবং কার্যে নতন উৎসাহ আসিল।

 বার্থেলোর অনুরোধে আমি ‘রসেন্দ্রসারসংগ্রহের’ ভূমিকার উপর নির্ভর করিয়া একটি প্রবন্ধ লিখিলাম এবং তাঁহার নিকট উহা পাঠাইয়া দিলাম। আরও বেশি আলোচনার ফলে আমি দেখিতে পাইলাম যে হিন্দু রসায়ন শিক্ষার্থীদের পক্ষে ‘রসেন্দ্রসারসংগ্রহ’ খুব বেশি মূল্যবান নহে। বার্থেলো আমার প্রবন্ধ অভিনিবেশ সহকারে পড়িলেন এবং তাহা অবলম্বন করিয়া Journal des Savants পত্রে একটি বিস্তৃত প্রবন্ধ লিখিলেন। তিনি ঐ মুদ্রিত প্রবন্ধের এক কপি এবং সিরিয়া, আরব ও মধ্য যুগের রসায়ন সম্বন্ধে তিন খণ্ডে সমাপ্ত তাঁহার বিরাট গ্রন্থও একখানি পাঠাইলেন। আমি সাগ্রহে ঐ গ্রন্থ পড়িলাম এবং সঙ্কল্প করিলাম যে ঐ আদর্শে হিন্দু রসায়নের ইতিহাস আমাকে লিখিতেই হইবে। আরও একটি কারণে আমার মনে উৎসাহ বর্দ্ধিত হইল। একদিন সন্ধ্যাকালে এসিয়াটিক সোসাইটির সভায় যোগ দিয়াছিলাম। সভাগৃহে টেবিলের উপর একখানি Journal des Savants দেখিতে পাইলাম এবং তাহাতে বার্থেলোর লিখিত একটি প্রবন্ধের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হইল।

 পড়িয়া রোমাঞ্চিতকলেবর হইলাম। আমি একজন রসায়নশাস্ত্রের নবীন অধ্যাপক।


  1. “আপনার গবেষণার চিত্তাকর্ষক ফলাফলের সংবাদে পুলকিত হইলাম। ইউরোপ এবং আমেরিকার ন্যায় এশিয়া খণ্ডেও যে বিজ্ঞানের সার্বভৌম এবং নৈর্ব্যক্তিক রূপের সমাদর ও চর্চা চলিয়াছে তাহা জানিয়া আনন্দ হইল”—