পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৪
আত্মচরিত

না যে, ঐরূপ কিছু করা দূরে থাকুক, ইংলণ্ড ভারতের রাজস্বের নানা ভাবে অপব্যয় করে এবং সামান্য কিছু অংশ শিক্ষার জন্য ব্যয় করে?” গোখেল ধীর গম্ভীর প্রকৃতির লোক ছিলেন, কিছুতেই উত্তেজিত হইতেন না। এই একবার মাত্র আমি তাঁহাকে ধৈর্যচ্যুত হইতে দেখিয়াছি। প্রাতভোজনের টেবিলে ইহার ফলে যাদুমন্ত্রের কাজ হইল। সকলেই নীরব হইলেন। ইহার কিছুক্ষণ পরে ডেকে গেলে কয়েকজন ভদ্রলোক আমার নিকট ইংরাজ বণিকটির ব্যবহারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করিলেন এবং বলিলেন যে, ইংরাজ বণিকটি যদি জানিতেন যে কাহার সঙ্গে কথা বলিতেছেন, তবে তিনি নিশ্চয়ই এমন সরফরাজী করিতেন না।

 ১৯০১ সালের শেষ ভাগে গোখেলের অতিথিরূপে একজন বিখ্যাত ব্যক্তি কলিকাতায় আসেন—ইনিই মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। বলাবাহুল্য, প্রথম হইতেই তাঁহার অসাধারণ ব্যক্তিত্বের প্রভাবে আমি তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিলাম। আমাদের দুইজনের প্রকৃতির মধ্যে একটি বিষয়ে সাদৃশ্য ছিল—ত্যাগ ও তিতিক্ষার প্রতি নিষ্ঠা। এই কারণেও তাঁহার প্রতি আমি আকৃষ্ট হইয়াছিলাম। তাহার পর বহু বৎসর অতীত হইয়াছে এবং মহাত্মাজীর প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও তাঁহার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতাও সঙ্গে সঙ্গে বর্দ্ধিত হইয়াছে।

 মহাত্মাজী তাঁহার আত্মজীবনীতে আমাদের প্রথম সাক্ষাতের বিবরণ দিয়াছেন, সতরাং তাহা আর এখানে বর্ণনা করিবার প্রয়োজন নাই। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ২৫ বৎসর পরেও, আমাদের কথাবার্তা সমস্তই তাঁহার স্মরণ আছে। একটি প্রয়োজনীয় বিষয়, তাঁহার মনে নাই। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রবাসী ভারতীয়দের দঃখ দুর্দশার মর্মস্পর্শী কাহিনী তাঁহার মুখেই আমি প্রথম শুনি। আমি ভাবিলাম এবং গোখেলও আমার সঙ্গে একমত হইলেন যে, যদি কলিকাতায় একটি সভা আহ্বান করা যায় এবং শ্রীযুত গান্ধী সে সভার প্রধান বক্তা হন, তাহা হইলে উপনিবেশ-প্রবাসী ভারতীয়দের দঃখ দুর্দশার কথা আমাদের দেশবাসী ভাল করিয়া উপলব্ধি করিতে পারিবে। এই উদ্দেশ্যে, প্রধানতঃ আমার উদ্যোগে অ্যালবার্ট হলে একটি জনসভা আহূত হইল এবং ‘ইণ্ডিয়ান মিররের’ প্রধান সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ সেন তাহার সভাপতির পদ গ্রহণ করিলেন। “ইংলিশম্যান” সংবাদপত্রও গান্ধীর পক্ষ উৎসাহের সহিত সমর্থন করিলেন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সমস্যা সম্বন্ধে কয়েকটি প্রবন্ধ লিখিলেন। ২০শে জানুয়ারী, ১৯০২, সোমবারের ‘ইংলিশম্যান’ হইতে—ঐ সভার একটি বিবরণ উদ্ধৃত হইল:—

দক্ষিণ আফ্রিকা সমস্যায় মিঃ এম, কে, গান্ধী

 “গতকল্য সন্ধ্যাকালে অ্যালবার্ট হলে মিঃ এম, কে, গান্ধী তাঁহার দক্ষিণ আফ্রিকার অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে একটি চিত্তাকর্ষক বক্তৃতা করেন। সভায় বহু জনসমাগম হইয়াছিল। মিঃ নরেন্দ্রনাথ সেন সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। রাজা প্যারীমোহন মুখার্জি, মাননীয় প্রোঃ গোখেল, মিঃ পি, সি, রায়, ভূপেন্দ্রনাথ বসু, পৃথ্বীশচন্দ্র রায়, জে, ঘোষাল, অধ্যাপক কাথাভাতে প্রভৃতি সভায় উপস্থিত ছিলেন। মিঃ গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকার অবস্থা প্রথমতঃ সাধারণ ভাবে বর্ণনা করিয়া সেখানে প্রবাসী ভারতীয়দের অবস্থা বিশেষ ভাবে আলোচনা করেন। তিনি বলেন যে, নেটালে ইমিগ্রেশন রেস্ট্রিকশান অ্যাক্ট, লাইসেন্স সম্বন্ধীয় আইন এবং ভারতীয় ছেলে মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারই প্রধান সমস্যা। ট্রান্সভালে ভারতীয়েরা কোন ভূসম্পত্তির মালিক হইতে পারে না এবং দুই একটি বিশেষ স্থান ব্যতীত কোথাও ব্যবসা-বাণিজ্য চালাইতে পারে না। তাহারা ফুটপাথ দিয়া হাঁটিতে পর্ষন্ত পারে না।