॥৵৹
অতি তরুণ বয়সেই তিনি উপলব্ধি করিয়াছিলেন যে প্রকৃতির সহিত সত্য পরিচয় না থাকিলে জীবনে অশিক্ষার তমসা দূরীভূত হয় না। তিনি বুঝিয়াছিলেন আমাদের অধিকাংশ পরাভবের মূলে আছে বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও কর্মশক্তির অকিঞ্চিৎকরতা। তাই তিনি কেবলমাত্র সাহিত্য ও ইতিহাস সাধনায় অনুরক্ত না থাকিয়া বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও কর্মশক্তির প্রভাবে দেশের দারিদ্র্য, অজ্ঞতা দূর করিতে এবং সমস্ত দেশব্যাপী তন্দ্রাচ্ছন্ন যুব শক্তিকে জাগ্রত করিয়া তুলিতে বদ্ধপরিকর হইলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার সময় তিনি ইউরোপের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সমিতিতে প্রবন্ধ লিখিয়া পাঠাইতেন। এই সকল প্রবন্ধে আচার্য দেবের মৌলিকত্ব, অসাধারণ মননশক্তি ও মনীষার ব্যঞ্জনা থাকিত। মারকিউরিয়াস নাইট্রাইট বা পারদ, সংক্রান্ত একাদশটি মিশ্রধাতুর আবিষ্কার করিয়া তিনি রাসায়নিক জগতে বিস্ময় উৎপাদন করিয়াছিলেন। রাসায়নিক জ্ঞানভাণ্ডারে তাঁহার দান বিশ্ববিশ্রুত। বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার তাঁহার তুলনাহীন সৃষ্টি। অগণিত শিক্ষার্থীকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়া উদ্বুদ্ধ করিবার জন্যই এই গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। বিজ্ঞানের জয়যাত্রার এই অভিযানে আচার্যদেব ছিলেন সর্বাধিনায়ক। কিন্তু তিনি প্রায়ই বলিতেন “সর্বত্র জয় অনুসন্ধান করিবে কিন্তু পুত্র এবং শিষ্যের নিকট পরাজয় স্বীকার করিয়া সুখী হইবে।” এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের কথা। তিনি বলিয়াছিলেন, “আমি প্রফুল্লচন্দ্রকে সেই আসনে অভিনন্দন জানাই যে আসনে প্রতিষ্ঠিত থেকে তিনি তাঁর ছাত্রের চিত্তকে উদ্বোধিত করেছেন—কেবলমাত্র তাকে জ্ঞান দেননি নিজেকে দিয়েছেন—যে দানের প্রভাবে সে নিজেকেই পেয়েছে। বস্তুজগতে প্রচ্ছন্ন শক্তিকে উদ্ঘাটিত করে বৈজ্ঞানিক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র তার চেয়ে গভীরে প্রবেশ করেছেন। কত যুবকের মনোলোকে ব্যক্ত করেছেন তার গৃহাস্থিত অনভিব্যক্ত দৃষ্টিশক্তি, বিচারশক্তি, বোধশক্তি।” আচার্যদেব আধুনিক ভারতীয় রসায়নাগারের স্রষ্টা। প্রেসিডেন্সি কলেজ ও সায়েন্স কলেজ রসায়নাগারে তিনি মৌনব্রতাবলম্বী, অধ্যবসায়শীল সুদক্ষ বৈজ্ঞানিক। প্রোফেসার মিলভ্যান লেভীর মনে এই রসায়নাগার এই লীলাময় শিক্ষাঘর যেখান হইতে নবভারতের তরুণ রাসায়নিকেরা রূপ লইয়া বাহির হইয়া আসিতেছে। আচার্যদেবের গবেষণা ভারতকে বিশ্বের বিজ্ঞানক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা দিয়াছে।
তখন দেশের দারুণ দুর্দিন। শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বেকারে দেশ পূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। আচার্যদেব দেখিতে পাইলেন বাংলার এই যুবক সম্প্রদায় অভিমানী, সংগ্রাম বিমুখ, পরিশ্রমকাতর এবং পরমুখাপেক্ষী। তাহাদের জীবনের এই অসহায় অবস্থা প্রেমিক প্রফুল্লচন্দ্রের চিত্তকে আন্দোলিত করিয়া তুলিল। বাঙ্গালীর প্রধান অবলম্বন চাকুরী। কিন্তু চাকুরী কোথায়? বাঙ্গালী যুবককে চাকুরীর ভিখারী না হইয়া কর্মঠ ও স্বাবলম্বী হইবার আহ্বান তিনি জানাইলেন। সকল প্রকার বিলাস বর্জন করিয়া সংযম ও অধ্যবসায়ের বলে তাহারা নব নব জ্ঞানের সম্পদ জয় করিয়া লইতে পারিবে। আচার্যদেব তাঁহার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী, প্রেম এবং আত্মবিশ্বাস লইয়া সহস্র জীবনের সমস্যা সমাধানে ব্রতী হইলেন। তাঁহার চিররুগ্ন দেহ এই কাজের গতিকে ব্যাহত করিতে পারে নাই। পথে পিছাইয়া পড়িবার মত ক্লান্তি তাঁহার ছিল না।