পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
দশম পরিচ্ছেদ
৮৯

তাঁহার সঙ্গে নূতন থিওরির ভবিষ্যৎ ফলাফল সম্বন্ধে আলোচনা করেন। বড়ই দুঃখের বিষয়, অঘোরনাথের মহৎ প্রতিভার দান হইতে ভারতবর্ষ, বলিতে গেলে বঞ্চিত হইয়াছে। অন্ততপক্ষে রসায়ন বিজ্ঞান সম্বন্ধে তিনি চেষ্টা করিলে অনেককিছু করিতে পারিতেন।

 অঘোরনাথ দেশে ফিরিয়া হায়দ্রাবাদ রাজ্যের শিক্ষাবিভাগের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি রাজনৈতিক দলাদলিতে লিপ্ত হন। ঐ সময়ে হায়দ্রাবাদ রাজ্যে সংগৃহীত মূলধন দ্বারা চান্দোয়া রেলওয়ে নির্মাণ করিবার জন্য আন্দোলন আরম্ভ হয় এবং অঘোরনাথ এই জাতীয় আন্দোলনের নেতা হন। তদানীন্তন পলিটিক্যাল এজেণ্টের নিকট ইহা ভাল লাগে নাই। উক্ত এজেণ্ট মহাশয় বোধ হয় মনে করিতেন যে, কেবল ব্রিটিশ ভারত নহে, দেশীয় রাজ্যও ব্রিটিশ শোষণনীতির কর্মক্ষেত্র হওয়া উচিত। সুতরাং ক্রুদ্ধ রেসিডেণ্ট বাঙালী যুবক অঘোরনাথকে হায়দ্রাবাদ হইতে বহিষ্কৃত করিলেন এবং তাঁহাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিজামের রাজ্য ত্যাগ করিতে আদেশ দিলেন। আমার স্মরণ হয়, বাল্যকালে আমি ‘হিন্দু পেট্রিয়টে’ সম্পাদক কৃষ্ণদাস পালের লেখা একটি প্রবন্ধ পড়িয়াছিলাম। তাহাতে স্কুলমাষ্টার অঘোরনাথকে রাজনীতির সংস্পর্শ ত্যাগ করিবার জন্য উপদেশ দেওয়া হইয়াছিল।

 আমি এমিল ফিসার এবং তাঁহার লেবরেটরিও দেখিলাম। তিনি এই সময়ে তাঁহার “Purine group” সম্বন্ধে গবেষণা শেষ করিয়াছেন মাত্র। প্রোটিন হইতে উৎপন্ন— ‘আমিনো-অ্যাসিডস্’ সম্বন্ধে গবেষণা করিতেছেন।

 বার্লিন হইতে আমি বার্ণ, জেনেভা এবং জুরিচে গেলাম, শেষোক্ত স্থানে আমি খুব যত্ন সহকারে ‘পলিটেকনিক’ বিদ্যালয় দেখিলাম। অধ্যাপক রিচার্ড লোরেঞ্জ একটি বৈদ্যুতিক বিভাগের কর্তা ছিলেন। আমি তাঁহার সঙ্গে পূর্বেই কয়েকবার পত্র ব্যবহার করিয়াছিলাম। কেননা তিনি জার্মান জার্নাল অব ইনরগ্যানিক কেমিষ্ট্রীর সম্পাদক ছিলেন এবং আমার কয়েকটি প্রবন্ধ ঐ জার্নালে প্রকাশিত হইয়াছিল। তৎপরে আমি ‘ফ্র্যাঙ্কফার্ট-অন-মেইন’ হইয়া পারি অভিমুখে যাত্রা করিলাম। ফ্র্যাঙ্কফার্টে গাইড আমাকে মহাকবি গ্যেটের স্মৃতিজড়িত একটি গৃহ দেখাইয়াছিলেন।

 ফ্রান্সের রাজধানী পারিকে আমি তীর্থক্ষেত্র রূপে গণ্য করিতাম। নব্য রসায়ন শাস্ত্রের উৎপত্তির ইতিহাস এই নগরীর সঙ্গে জড়িত। এই খানেই ল্যাভোসিয়ারের গবেষণার ফলে এমন সমস্ত সত্য আবিষ্কৃত হইয়াছিল, যাহাতে পুরাতন “ফ্লোজিস্টন মতবাদ” নিরাকৃত হয় এবং এই স্থানেই একে একে বহু কৃতী রাসায়নিক তাঁহার পতাকাতলে সমবেত হন এবং তাঁহার মতবাদ গ্রহণ করেন। আধুনিক রসায়ন বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতার (ল্যাভোসিয়ার) নামের সঙ্গে বার্থেলো, ফোরক্রয়, গ্যয়টন ডি মর্ভোর নাম চিরদিনই উল্লিখিত হইবে।[] পারি নগরী গেলুসাক, থেনার্ড, ক্যাভেণ্টো এবং পেলেটিয়ার (কুইনীনের আবিষ্কর্তাগণ) এবং আরও অনেক বৈজ্ঞানিকের কর্মক্ষেত্র। ইঁহারা সকলেই রসায়ন বিজ্ঞানের প্রথম যুগে জ্ঞানরূপে আলোক বর্তিকা হস্তে অগ্রসর হইয়াছিলেন। বস্তুত, গত শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত পারি সম্বন্ধে আডল্‌ফ্ ওয়ার্জের গর্বোক্তি সত্য বলিয়া গণ্য হইতে পারিত।[]

 পারিতে পৌছিয়া প্রথমেই আমি মাসিয়ে সিলভ্যাঁ লেভির সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলাম।


  1. যাঁহারা এ বিষয়ে আরও বিস্তৃত রূপে জানিতে চান, তাঁহারা মৎকৃত Makers of Modern Chemistry গ্রন্থ পড়িতে পারেন।
  2. রসায়ন বিদ্যা ফরাসী বিজ্ঞান, ইহার প্রতিষ্ঠাতা অমরকীর্তি ল্যাভোসিয়ার।