পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯০
আত্মচরিত

আমার ‘হিন্দু রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাসে’ সিলভ্যাঁ লেভিকে আমি বৌদ্ধ সাহিত্য সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ এবং প্রামাণিক ব্যক্তি বলিয়া উল্লেখ করিয়াছিলাম। কলিকাতা হইতে তাঁহার সঙ্গে আমি পত্র ব্যবহারও করিয়াছিলাম। তাঁহার কক্ষে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম যে তিনি পতঞ্জলির “মহাভাষ্য” (সম্ভবতঃ গোল্ডষ্টুকারের সংস্করণ) অধ্যয়নে নিমগ্ন আছেন। স্থির হইল যে পরদিন সকালে আমি “কলেজ ডি ফ্রান্সে” তাঁহার সঙ্গে দেখা করিব এবং তিনি তাঁহার সহাধ্যাপক মঁসিয়ে বার্থেলোর সঙ্গে আমার পরিচয় করাইয়া দিবেন। আমি নির্দিষ্ট সময়ে ‘কলেজ ডি ফ্রান্সে’ উপস্থিত হইলাম এবং ঘটনাক্রমে কয়েক মিনিট পরেই বার্থেলো প্রাঙ্গণের বিপরীত দিক দিয়া তাঁহার গবেষণাগারে প্রবেশ করিলেন। অধ্যাপক লেভি উক্ত বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে পরিচয় করাইয়া দিলেন, আমার সর্বাঙ্গে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহ বহিয়া গেল। মনে হইল আমি অবশেষে সেই বিখ্যাত মনীষী এবং বিজ্ঞানাচার্যের সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছি যিনি সমস্ত জীবন পাশ্চাত্য রসায়ন বিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ইতিহাসের রহস্য ভেদ করিতে ব্যয় করিয়াছেন এবং যিনি “সিনথেটিক রসায়ন শাস্ত্রের”—অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা বলিয়া গণ্য।

 বার্থেলো আমাকে তাঁহার লেবরেটরিতে লইয়া গেলেন এবং তাঁহার আবিষ্কৃত কাচাধারে রক্ষিত যন্ত্রাদি সযত্নে দেখাইলেন। অর্ধ্ব শতাব্দী পূর্বে ‘সিনথেটিক কমপাউণ্ড’ সমূহে বিশ্লেষণের জন্য তিনি এই সমস্ত যন্ত্র ব্যবহার করিয়াছিলেন। তাঁহার আমন্ত্রণে তাঁহার বাড়ীতে আমি গেলাম। ‘একাডেমি অব সায়েন্সের’ তিনি স্থায়ী সেক্রেটারী ছিলেন এবং সেই হিসাবে ইনষ্টিটিউটেরই একাংশে তাঁহার বাসস্থান নির্দিষ্ট ছিল। বার্থেলো পূর্ব হইতেই তাঁহার এক পুত্রকে সাক্ষাতের সময় উপস্থিত থাকিবার জন্য আমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। পুত্র কিছুদিন বিলাতে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। সুতরাং ইংরাজীতে বেশ কথাবার্তা বলিতে পারিতেন। সুতরাং তাঁহার সাহায্যে বার্থেলোর সঙ্গে আমি প্রায় এক ঘণ্টাকাল কথাবার্তা বলিলাম। বার্থেলো আমাকে একাডেমীর অধিবেশনে উপস্থিত থাকিবার জন্যও নিমন্ত্রণ করিলেন। ৭১ বৎসর বয়স্ক প্রেসিডেণ্ট প্রসিদ্ধ রাসায়নিক মঁসিয়ে ট্রুষ্টের সঙ্গেও তিনি আমার পরিচয় করাইয়া দিলেন। ‘লা নেচার’ পত্রে ঐ অধিবেশনের যে বিবরণ বাহির হইয়াছিল তাহাতে আমার সম্বন্ধে উল্লেখ ছিল। পারিতে থাকিবার সময় আমি মাসিয়ে সিলভ্যাঁ লেভির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসিয়াছিলাম। তিনি আমাকে একটি সান্ধ্য বৈঠকে নিমন্ত্রণ করেন, এবং আমার হোটেলে আসিয়া আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই স্থানে মঁসিয়ে পামির কর্ডিয়ারের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। ইনি ফরাসী চন্দননগরে কয়েক বৎসর কাজ করেন এবং তিব্বতীয় ভাষা শিক্ষা করেন। বৌদ্ধ সাহিত্যের উপর ভিত্তি করিয়া তিনি ভারতীয় চিকিৎসা বিদ্যা সম্বন্ধে কয়েকখানি গ্রন্থ লিখেন। আমার যতদূর মনে পড়ে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সহযোগে তাঁহার সঙ্গে কলিকাতায় আমার পরিচয় হয়।

 আমি বৈজ্ঞানিক ময়সানের লেবরেটরিও দর্শন করি। সাধারণের নিকট তিনি কারবাইড অব ক্যালসিয়াম এবং কৃত্রিম হীরকের আবিষ্কর্তারূপেই অধিকতর পরিচিত। উক্ত প্রসিদ্ধ রসায়নবিৎ অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে কৃত্রিম হীরকের কণাসমূহ আমাকে দেখাইয়াছিলেন। আমি দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছিলাম যে, ময়সান তাঁহার অজৈব রসায়ন সম্বন্ধীয় বৃহৎ সংগ্রহ গ্রন্থে (এনসাইক্লোপিডিয়া) মৎকৃত মার্কিউরাস নাইট্রাইট বিষয়ক গবেষণার বিস্তৃত বিবরণ দিয়াছেন।

 বার্থেলো এবং তাঁহার বহুমুখী প্রতিভার কিঞ্চিৎ পরিচয় না দিলে আমার পারি দর্শনের বিবরণ অসম্পূর্ণ থাকিয়া যাইবে। অর্ধ শতাব্দীরও অধিককাল তিনি রসায়ন