দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে কার্যে অগ্রসর হয়। প্রাথমিক যে কোন বাধা-বিপত্তিতে তাহারা হতাশ হইয়া পড়ে। তাহাদের জীবনপথ কেহ কুসুমাস্তীর্ণ করিয়া রাখে, ইহাই যেন তাহাদের ইচ্ছা। পক্ষান্তরে ইংরাজ যুবক বাধা-বিপত্তিতে আরও দৃঢ়সঙ্কল্প হইয়া উঠিবে। তাহার অন্তর্নিহিত শক্তি ইহাতে বিকাশপ্রাপ্ত হয়। বাঙালীরা নিরানন্দ জাতি, জীবনকে উপভোগ করিতে জানে না। তাহারা স্বপ্নাচ্ছন্ন এবং আধাঘুমন্ত জীবন যাপন করিতে ভালবাসে। সাধারণ বাঙালীকে দেখিলে টেনিসনের ‘কমলবিলাসী’ (Lotus Eaters) কবিতার কথা মনে পড়ে।
বিষাদভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমি আমাদের জাতীয় চরিত্রের এই দৌর্বল্যের কথা ভাবিতেছিলাম—এমন সময় এমন একটা ব্যাপার ঘটিল, যাহা ভাগবত ইচ্ছা বলিয়া মনে হইল। অন্তত তখনকার মত ইহা জীবন্মৃত বাঙালীর দেহে যেন নূতন প্রাণ সঞ্চার করিল। আমি লর্ড কার্জন কর্তৃক বঙ্গভঙ্গের কথাই বলিতেছি।
আমার অনেক সময়েই বিশেষ করিয়া মনে হইয়াছে যে, বাংলা, আসাম ও উড়িয়া, জাতির দিক হইতে না হইলেও, ভাষার দিক হইতে এক। বাংলা, আসামী ও উড়িয়া ভাষা একই মূল ভাষা হইতে উদ্ভূত। ইহা কতকটা আশ্চর্যের বিষয়। কেন না পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্র এই দুই বড় বড় নদী, পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গকে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখিয়াছে। শ্রীচৈতন্যের শেষ জীবনে উড়িষ্যাই তাঁহার কর্মক্ষেত্র ছিল এবং উড়িষ্যার সম্রাট প্রতাপরুদ্র তাঁহার ধর্মমত গ্রহণ করিয়া শিষ্য হইয়াছিলেন। বাংলা ভাষায় রচিত শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত, শ্রীচৈতন্য ভাগবত প্রভৃতি বৈষ্ণব গ্রন্থ এবং বাংলা কীর্তনের দ্বারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য উড়িষ্যায় জনপ্রিয় হইয়া উঠিয়াছিল। অপর পক্ষে যে কোন বাঙালী একটু চেষ্টা করিলেই আসামী ভাষা বুঝিতে পারে। বস্তুত ভাষার দিক হইতে এই তিন প্রদেশকে একই বলা যাইতে পারে।
লর্ড কার্জন সাম্রাজ্যবাদের দূতরূপে শঙ্কিত হৃদয়ে দেখিলেন, বাংলা দেশে জাতীয় ভাব দ্রুতবেগে বৃদ্ধি পাইতেছে। বাঙালীর সাহিত্য ঐশ্বর্যশালী হইয়া উঠিয়াছে এবং তাহা ভারতের সমগ্র ভাষার মধ্যে শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছে। রাজা রামমোহন রায়ের সময় হইতে বাঙালীরা পাশ্চাত্য সাহিত্য বিশেষ যত্নসহকারে চর্চা করিয়াছে এবং বাংলার সন্তানেরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হইয়া উঠিয়াছে। একটা জাতিগঠনের জন্য যাহা প্রয়োজন, তাহা নীরবে ধীরে ধীরে প্রবল হইয়া উঠিতেছে। ‘ভেদনীতি’ রোম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতাদের একটা প্রিয় নীতি ছিল এবং কার্জন তাহাদের আদর্শ অনুসরণ করিয়া ভারতে রোমক নীতি চালাইতে প্রবৃত্ত হইলেন। বাংলা দেশের মানচিত্র সর্বদা তাঁহার চোখের সম্মুখে ছিল এবং এমন একটা ভীষণ অস্ত্র নির্মাণ করিয়া তিনি বাঙালী জাতির উপর নিক্ষেপ করিলেন, যাহার আঘাত সামলাইতে তাহাদের বহুদিন লাগিবে। ম্যাকিয়াভেলির দুষ্ট বৃদ্ধি ও নিষ্ঠুর দূরদর্শিতার সঙ্গে তিনি বাংলাদেশকে দুই ভাগে বিভক্ত করিয়া ফেলিলেন। এমন ব্যবস্থা করিলেন যাহাতে উত্তর পূর্ব ভাগে মুসলমান সংখ্যাধিক্য হয়। তিনি তাঁহার মোহমুগ্ধ পরিষদবর্গের সাহায্যে মুসলমান জনসাধারণের, বিশেষভাবে তাহাদের নেতাদের সম্মন্ধে, নানা প্রলোভন প্রদর্শন করিতে লাগিলেন, যাহাতে তাহারা হিন্দুদের নিকট হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে। বাংলাদেশের হৃদয়ে এমন এক শাণিত অস্ত্র সন্ধান করা হইল, যাহার ফলে বাঙালী জাতির সংহতি শক্তি নষ্ট হয়, হিন্দু-মসলমানে চির বিরোধ উপস্থিত হয় এবং বাংলার জাতীয়তা ধ্বংস হয়।
কৌশলী সাম্রাজ্যবাদী গোপনে যে অস্ত্র শানাইয়া প্রয়োগ করে, অধঃপতিত জাতি তাহার পরিণাম ফল প্রায়ই ভাবিতে ও বুঝিতে পারে না। সৌভাগ্যক্রমে, বাংলা দেশে