একাদশ পরিচ্ছেদ
বাংলায় জ্ঞানরাজ্যে নব জাগরণ
হিন্দুদের প্রতিভা অতীব সূক্ষ্ম এবং তাহাদের মনের গতি দার্শনিকতার দিকে। জেমস্ মিলের নিম্নলিখিত কথাগুলিতে কিছুমাত্র অতিরঞ্জন নাই: “কোন একটি দার্শনিক সমস্যার আলোচনায় হিন্দু বালকরা আশ্চর্য বুদ্ধির খেলা দেখাইতে পারে, কিন্তু একজন ইংরাজ বালকের নিকট তাহাই দুর্বোধ্য প্রহেলিকা বলিয়া বোধ হয়।” কিন্তু কেবলমাত্র দার্শনিক বিদ্যা দ্বারা যে হিন্দুজাতির উন্নতি হইবে না, ইহা বহুদিন হইতেই বুঝিতে পারা গিয়াছিল। এক শতাব্দীরও অধিককাল পূর্বে রাজা রামমোহন রায় বড়লাট লর্ড আমহার্স্টের নিকট যে পত্র লিখেন, তাহাতে তিনি সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার বিরদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন:—
“আমরা দেখিতেছি যে, গভর্ণমেণ্ট হিন্দু পণ্ডিতদের শিক্ষকতায় সংস্কৃত বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য উদ্যোগী হইয়াছেন। এদেশে যেরূপ শিক্ষা প্রচলিত আছে, তাহাই এই সমস্ত বিদ্যালয়ে শিখাইবার ব্যবস্থা হইবে। ইউরোপে লর্ড বেকনের অভ্যুদয়ের পূর্বে যেরূপ বিদ্যালয় ছিল, ইহা ঠিক সেই শ্রেণীর এবং ইহাতে যে ব্যাকরণের কূটতর্ক এবং দার্শনিক সূক্ষ্মতত্ত্ব শিখান হইবে, তাহা ঐ বিদ্যার অধিকারী বা সমাজের পক্ষে কোন কাজে লাগিবে না। দুই হাজার বৎসর পূর্বে যাহা জানা ছিল, এবং পরে তাহার সঙ্গে তার্কিক লোকেরা আরও যে সব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার বিতর্ক যোগ করিয়াছেন, ছাত্রেরা তাহারই জ্ঞান লাভ করিবে। ভারতের সর্বত্র এখন সাধারণতঃ এইরূপে শিক্ষাই প্রদত্ত হইয়া থাকে।.....ব্রিটিশ জাতিকে যদি প্রকৃত জ্ঞান হইতে বঞ্চিত করিবার ইচ্ছা থাকিত, তবে পাদরীদের প্রচারিত বিদ্যার পরিবর্তে বেকন কর্তৃক প্রচারিত বিদ্যা তাহাদিগকে শিখিতে দেওয়া হইত না। কেন না পাদরীদের প্রচারিত বিদ্যার দ্বারা মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকারে চিরদিনের জন্য আচ্ছন্ন রাখা যাইতে পারিত। ঠিক সেইভাবে সংস্কৃত বিদ্যার দ্বারা ভারতকে চিরদিনের জন্য অজ্ঞতায় নিমজ্জিত রাখা যাইতে পারে—তাহাই যদি ব্রিটিশ পার্লামেণ্টের অভিপ্রায় হয়। কিন্তু গবর্ণমেণ্টের উদ্দেশ্য এদেশবাসীর উন্নতিসাধন করা, সুতরাং তাঁহাদের অধিকতর উদার এবং উন্নত শিক্ষা প্রণালী প্রবর্তন করা উচিত। ইহাতে গণিত, প্রাকৃতদর্শন, রসায়নশাস্ত্র, জ্যোতিষ এবং অন্যান্য কার্যকরী বিদ্যা শিক্ষার ব্যবস্থা থাকিবে। সংস্কৃত বিদ্যা শিখাইবার জন্য যে অর্থব্যয়ের প্রস্তাব হইতেছে, ঐ অর্থ দ্বারা যদি ইউরোপে শিক্ষিত কয়েকজন যোগ্য পণ্ডিত ব্যক্তিকে নিযুক্ত করা হয় এবং প্রয়োজনীয় গ্রন্থাদি, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি সমন্বিত একটি কলেজ স্থাপন করা হয়, তাহা হইলেই ঐ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইবে।
নব্য বাংলা, তথা নব্য ভারতের প্রবর্তক বিখ্যাত সংস্কারক রাজা রামমোহন নিজে সংস্কৃত বিদ্যায় প্রগাঢ় পণ্ডিত ছিলেন, এই কথা স্মরণ রাখিলে, আমরা উদ্ধৃত পত্রখানির মূল্য বুঝিতে পারিব। রাজা রামমোহনই বাংলা দেশে প্রথম উপনিষদ আলোচনার পথ প্রদর্শন করেন। তিনি নিজে বাংলা ও ইংরাজীতে কয়েকখানি উপনিষদের অনুবাদ করেন।