ফরাসী ভাষা একেবারেই নাই। তখনকার দিনে মার্জিতরুচি পণ্ডিতদের সাহিত্যে মাতৃভাষার স্থান ছিল না। এই অমরকীর্তি প্রহসনকারের প্রথম জীবনের রচনায় ইটালীয়স্পেনীশ প্রভাব যথেষ্ট দেখা যায়, কিন্তু তাঁহার পরিণত বয়সের শ্রেষ্ঠ রচনাসমূহে ‘গেলিক’ প্রভাব স্পষ্টই পড়িয়াছে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। নব্য বাংলার কাব্যসাহিত্যের ‘জনক’ পুরাতন হিন্দু স্কুলের ছাত্র এবং মাতৃভাষার প্রতি তাঁহার অত্যন্ত অবজ্ঞা ছিল দান্তে ও মিলটনের কাব্যরসেই তিনি আনন্দ পাইতেন এবং তাঁহার প্রথম কাব্য “দি ক্যাপটিভ লেডী” তিনি ইংরাজী ভাষাতেই রচনা করেন। মিল্টনও প্রথমে ল্যাটিন কবিতা রচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। কিন্তু পরে তিনি তাঁহার ভ্রম বুঝিতে পারেন। মেকলে যথার্থই বলিয়াছেন যে, কোন মৃত ভাষায় কবিতা রচনা করা, এক দেশ হইতে আনীত চারাগাছ অন্য দেশে ভিন্ন মাটিতে লাগানোর মত। বিদেশে নূতন জমিতে সে গাছ কিছুতেই স্বাভাবিকরূপে শক্তিশালী হইতে পারে না। যে দেশে এইরূপ ‘বিদেশী কবিতা’ রচিত হয়, সেখানে মাতৃভাষায় কোন শক্তিশালী কাব্যের সৃষ্টি হইতে পারে না। যেমন ফলগাছের টবে ওক বৃক্ষ জন্মে না।
মিল্টনের ন্যায় মধুসূদন দত্তও শীঘ্রই বুঝিতে পারিলেন যে, সাহিত্যে স্থায়ী আসন এবং যশোলাভ করিতে হইলে, তাঁহাকে মাতৃভাষাতেই কাব্য রচনা করিতে হইবে। তাহার ফলে তিনি বাংলা ভাষায় তাঁহার অমর কাব্য ‘মেঘনাদ বধ’ দান করিয়া গিয়াছেন। অবশ্য, এই অমর কাব্যে স্বর্গ ও নরকের বর্ণনা এবং কয়েকটি চরিত্র চিত্রনে আমরা হোমর, ভার্জিল, দান্তে, তাসো, মিল্টন প্রভৃতি পাশ্চাত্য কবিদের ভাবের ছায়াপাত দেখিতে পাই। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্রাজুয়েট বঙ্কিমচন্দ্রকে পরবর্তী যুগের লোক বলা যাইতে পারে। কিন্তু তাঁহারও ইংরাজী ভাষার প্রতি ঐরূপ মোহ ছিল এবং তাঁহার প্রথম উপন্যাস Rajmohan’s Wife (রাজমোহনের পত্নী) তিনি ইংরাজী ভাষাতেই রচনা করেন। কিন্তু তিনি শীঘ্রই তাঁহার ভ্রম বুঝিতে পারেন এবং বিদেশী ভাষা ত্যাগ করিয়া মাতৃভাষাতেই সাহিত্য সৃষ্টি করিতে আরম্ভ করেন। ফলে বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্যে অবিনশ্বর কীর্তি রাখিয়া গিয়াছেন।
অন্য সাহিত্য হইতে কিছু গ্রহণ করার অর্থ কেবলই অন্ধ অনুকরণ বা মৌলিকতার অভাব নয়। এমার্সন বলিয়াছেন—“সর্ব প্রধান প্রতিভাও অন্যের নিকট অশেষরূপে ঋণী।... এমন কথাও বলা যায় যে প্রতিভার শক্তি আদৌ মৌলিক নয়।” অন্যত্র এমার্সন বলিয়াছেন,—“সেক্সপীয়র তাঁহার অন্যান্য সাহিত্যিক সহকর্মীদের ন্যায় অপ্রচলিত পুরাতন নাটকের দোষগুণ বিচার করিয়া তাহা হইতে উৎকৃষ্ট অংশ গ্রহণ করিয়াছিলেন, কেন না এরূপ ক্ষেত্রেই যথেচ্ছ পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ চলিতে পারে।” দৃষ্টান্ত স্বরূপ ‘হ্যামলেট’ নাটকের কথা উল্লেখ করা যায়। খুব সম্ভব, ১৫৮৯ খৃষ্টাব্দে কীড নামক জনৈক নাট্যকার কর্তৃক ঐ বিষয়ে একখানি নাটক রচিত হইয়াছিল। জাতির নবজাগরণের ইতিহাসে দেখা যায়, প্রচুর অনুকরণের সঙ্গে সঙ্গে, চিন্তা ও ভাবের গ্রহণ ও সমীকরণ চলিতে থাকে এবং ইহা শীঘ্রই জাতীয় সাহিত্যের অংশ হইয়া উঠে।
আরব সাহিত্যের উন্নতি ও বিকাশেও ইহার দৃষ্টান্ত দেখা যায়। রক্ষণশীল উমায়েড খলিফাগণ মানসিক শক্তির দিক হইতে অলস বলা যাইতে পারে। এই সময়ে আরবে সাহিত্য বলিতে বিশেষ কিছু ছিল না। বেদুইনদের জীবনের ঘটনাবলীই প্রধানত আরবীয় কবিতার বিষয় ছিল। কিন্তু আবাসিদদের শাসনকালে আরব সাহিত্যে মোসলেম জীবনের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ দেখা যায়। প্রধানত গ্রীক সাহিত্যের অনুকরণ করিয়াই এই আরব সাহিত্য ঐশ্বর্যশালী হইয়া উঠিয়াছিল। খলিফা মনসুর ও মামুনের সময়ে আরব সাহিত্যের উপর