পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
একাদশ পরিচ্ছেদ
৯৭

গ্রীক সাহিত্যের প্রভাব পূর্ণরূপে বিস্তৃত হইয়াছিল। এরিষ্টোটল, প্লেটো, গ্যালেন, টোলেমী এবং নব্য প্লেটোনিষ্ট প্লোটিনাস ও পোরফিরির গ্রন্থাবলী মূল গ্রীক এবং সীরিয় ভাষা হইতে অনূদিত হইয়াছিল। ফালাসিফা-পন্থীদের (অর্থাৎ যাঁহারা মূল গ্রীক ভাষা হইতে গ্রহণ করিয়াছিলেন) মধ্যে আলকিণ্ডী, আল ফোরাবি, ইবন সিনা, আল রাজি এবং স্পেনীয় দার্শনিক ইবু রসদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

 “বাণিজ্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানরাজ্যেরও প্রসার হইতে লাগিল—প্রাচ্যে তৎপূর্বে যাহা কখনও দেখা যায় নাই। বোধ হইল যেন খলিফা হইতে আরম্ভ করিয়া অতি সাধারণ লোক পর্যন্ত সকলেই শিক্ষার্থী এবং সাহিত্যের উৎসাহদাতা হইয়া উঠিল। জ্ঞানের অন্বেষণে লোকে তিনটি মহাদেশ ভ্রমণ করিয়া গৃহে ফিরিত। মধুমক্ষিকা যেমন নানা স্থান হইতে মধু আহরণ করিয়া আনে, ইহারাও তেমনি নানা দেশ হইতে অমূল্য বিদ্যা আহরণ করিয়া আনিত,—শিক্ষার্থীদের দান করিবার জন্য। কেবল তাহাই নহে,—তাহারা অক্লান্ত অধ্যবসায় সহকারে বিরাট বিশ্বকোষসমূহ সঙ্কলন করিতে লাগিল—যেগগুলি বলিতে গেলে অনেকস্থলে বর্তমান বিজ্ঞানের জন্মদাতা।” (নিকলসন, আরব সাহিত্যের ইতিহাস, ২৮১ পৃঃ)। মধ্যযুগে আরবেরা গণিত ও দর্শনের জ্ঞানভাণ্ডারে যাহা দান করিয়াছিল, এখানে তাহার উল্লেখ করিবার প্রয়োজন নাই। আরবেরা যে আবার গণিত ও চিকিৎসাবিদ্যার জন্য ভারতের নিকট ঋণী, সে কথাও এখানে বলা নিষ্প্রয়োজন।[]

 আরবদের চরম উন্নতির সময়ে, তাহারা মধ্যযুগের ইউরোপে জ্ঞানের প্রদীপ বহন করিয়া লইয়া গিয়াছিল এবং ল্যাটিন সাহিত্যের উপর অশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। জ্ঞানরাজ্যে এসিয়া ও ইউরোপের পরস্পর আদান প্রদানের উপর একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ই লেখা যাইতে পারে।

 উইলিয়াম কেরী ও তাঁহার প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য গোষ্ঠীর সময় হইতে (১৮০০-২৫) ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আলোচনা করিলে দেখা যাইবে যে, এই সময়ে যে সমস্ত গ্রন্থ লিখিত হইয়াছিল, তাহার অধিকাংশই উচ্চশ্রেণীর ইংরাজী সাহিত্যের অনুবাদ, কতকগুলি আবার সংস্কৃত, পারসী এবং উর্দু গ্রন্থের অনুবাদ।

 ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রথম বয়সের লেখা “বেতাল পঞ্চবিংশতি” হিন্দী গ্রন্থ এবং তাঁহার পরিণত বয়সের লেখা “শকুন্তলা” ও “সীতার বনবাস” কালিদাস ও ভবভূতির গ্রন্থ অবলম্বনে রচিত। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের “কথামালা” “ঈসপস্ ফেবলস্”-এর আদর্শে রচিত। তাঁহার “জীবন চরিত” বহুলাংশে চেম্বার্সের “বাইওগ্রাফির” অনুবাদ।

 সেক্সপীয়রের নাটকাবলীও বাংলাতে অনূদিত হইয়াছিল। প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক অক্ষরকুমার দত্তই প্রথমে জ্যোতিষ ও প্রাকৃত বিজ্ঞানের গ্রন্থ অনুবাদ করিয়া বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেন। রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রাকৃতিক ভূগোল, ভূবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ক গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেন। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের “বিদ্যা কল্পদ্রুম”-এর নাম পূর্বেই উল্লেখ করিয়াছি। ইহা বাংলা ও ইংরাজী ভাষায় লিখিত সংগ্রহ-গ্রন্থ। মূল ইংরাজী গ্রন্থ হইতে উৎকৃষ্ট অংশসমূহ বাছিয়া বাংলা অনুবাদসহ ইহাতে প্রকাশ করা হইয়াছিল। এইরূপ হওয়াই উচিত। প্লটার্কের গ্রন্থ যদি নর্থ ইংরাজীতে অনুবাদ না করিতেন, তবে সেক্সপীয়রের ‘জুলিয়াস সিজার’, ‘কোরিওলেনাস’, এবং ‘অ্যাণ্টনি ও ক্লিওপেট্রা’ নাটক লিখিত হইত না। দিনেমার লেখক গ্র্যামাটিকাসের গ্রন্থ যদি ইংরাজীতে অনূদিত না হইত, তবে


  1. ‘হিন্দু রসায়নের ইতিহাস’—৬ষ্ঠ অধ্যায়, ‘ভারতের নিকট আরবের ঋণ’,—দ্রষ্টব্য।