জগৎ হয়ত “হ্যামলেট” নাটক হইতে বঞ্চিত হইত। আমাদের সাহিত্যের পূর্বাচার্যগণ পরবর্তী লেখকদের জন্য পথ প্রস্তুত করিয়া গিয়াছিলেন। প্রথম বয়সে বিদেশী ধাত্রীর স্তন্যপান করিয়া শিশু ক্রমে পরিপুষ্ট হইয়াছিল। শেষে তাহার পক্ষে আর বাহিরের খাদ্যের প্রয়োজন ছিল না। বিদেশী সাহিত্যের অনুবাদ ও অনুকরণের যুগের পর মৌলিক প্রতিভার যুগ আসিল। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ মৌলিক প্রতিভায় পূর্ণ; ইহা ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের বাঙালী সমাজের নিখুঁত চিত্র। ইহাতে প্রথম যুগের বাংলা গদ্যের ন্যায় সংস্কৃত সাহিত্যের আদর্শে শব্দালঙ্কারের আড়ম্বর নাই—প্যারীচাঁদ মিত্রের সরল সহজ শক্তিশালী চলিত ভাষা। শ্লেষ ও বিদ্রূপবাণ প্রয়োগেও তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তিনিও হিন্দু কলেজের ছাত্র এবং কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ প্রভৃতির সহাধ্যায়ী ছিলেন। প্রাচ্য পাশ্চাত্যের সঘর্ষে বাংলার জ্ঞানরাজ্যে এক আশ্চর্য নব জাগরণের বিকাশ দেখা গিয়াছিল।
ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল জাতিভেদ প্রথার উচ্ছেদ, সামাজিক বৈষম্য বিলোপ এবং নারীজাতির মধ্যে শিক্ষাবিস্তার করিয়া তাহাদের কল্যাণসাধন। বিশাল হিন্দু সমাজ যদিও ব্রাহ্ম মত ও কার্যধারা সম্পূর্ণরূপে অনুমোদন করিত না, তবু তাহার হৃদয়ের যোগ ঐ আন্দোলনের সঙ্গে ছিল এবং হিন্দু সমাজ ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলন দ্বারা প্রভাবাম্বিত হইয়াছিল তাহাতেও সন্দেহ নাই।
চারিদিকেই ভাববিপ্লব দেখা যাইতেছিল। একটা নূতন জগতের দ্বার খুলিয়া গিয়াছিল, নূতন আশা আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হইয়াছিল। বহুযুগের সুপ্তি ও আলস্য জাগ্রত হইয়া নব্য বাংলা অনুভব করিতে লাগিল, হিন্দু জাতির মধ্যে ভবিষ্যতের একটা বিপুল সম্ভাবনা আছে। এই সময়ের সাহিত্য দেশপ্রেমের মহৎভাবে পূর্ণ। লোকের মনের রুদ্ধভাব প্রকাশ এবং অধীন জাতির অভাব-অভিযোগ ব্যক্ত করিবার জন্য সংবাদপত্র ও রাজনৈতিক সভা-সমিতিও প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। প্রধানত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উৎসাহ ও আনুকূল্যে দেশের নানাস্থানে স্কুল ও কলেজসমূহ স্থাপিত হইতেছিল। তৎসত্ত্বেও বিজ্ঞান তাহার যোগ্য মর্যাদা পায় নাই। কতকগুলি সরকারী কলেজে উদ্ভিদ্ বিদ্যা, রসায়ন বিদ্যা এবং পদার্থ বিদ্যা পড়ান হইত বটে, কিন্তু বিজ্ঞান তখনও তাহার যোগ্য আসনে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। বিজ্ঞানের অনুশীলন কেবল বিজ্ঞানের জন্যই করিতে হইবে, এবং তাহার জন্য সানন্দে আত্মোৎসর্গ করিতে পারে, এমন লোকের প্রয়োজন। কেবল তাহাই নহে, জাতীয় সাহিত্যে বিজ্ঞান তাহার যোগ্য স্থান লাভ করিবে, এবং তাহার আবিষ্কৃত সত্যসমূহ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কাজে লাগিবে। বিজ্ঞান জাতীয় সম্পদ ও স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধির সহায়স্বরূপ হইবে। মানুষ ও পশু উভয়েই যে সব ব্যাধির আক্রমণে কাতর, বিজ্ঞান তাহা দূর করিবার ব্রত গ্রহণ করিবে। প্রত্যেক উন্নতিশীল জাতির জীবনের সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্বন্ধ অতি ঘনিষ্ঠ এবং তাহার কর্মক্ষেত্র ক্রমেই প্রসার লাভ করিতেছে। এককথায় বিজ্ঞানকে মানুষের সেবায় নিযুক্ত করা হইয়াছে।
দুর্ভাগ্যক্রমে, হিন্দু মস্তিষ্কক্ষেত্র বহুকাল অকর্মণ্য অবস্থায় থাকিয়া নানা আগাছা কুগাছায় পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি পরীক্ষায় বিজ্ঞান পাঠ্যরূপে নির্দিষ্ট হইয়াছিল বটে, কিন্তু, হিন্দু যুবক গতানুগতিক ভাবে বিজ্ঞান শিখিত, ইহার প্রতি তাহাদের প্রকৃত অনুরাগ ছিল না। তাহার উদ্দেশ্য কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ছাপ’ নেওয়া, যাহাতে ওকালতী, কেরাণীগিরি, সরকারী চাকুরী প্রভৃতি পাইবার সুবিধা হইতে পারে। ইউরোপে গত চার শতাব্দী ধরিয়া বিজ্ঞানের এমন সব সেবক জন্মিয়াছেন, যাঁহারা