কোনরূপ আর্থিক লাভের আশা না করিয়া বিজ্ঞানের জন্যই বিজ্ঞান চর্চা করিয়াছেন। এমন কি সময়ে সময়ে তাঁহারা বিজ্ঞানের জন্য ‘ইনকুইজিশান’ বা প্রচলিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন ‘ধর্মের অত্যাচার’ সহ্য করিয়াছেন। প্রকৃতির রহস্য আবিষ্কার করিবার অপরাধে রোজার বেকন (১২১৪—১২৮৪) কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিলেন। কোপারনিকস তাঁহার অমর গ্রন্থ চল্লিশ বৎসর প্রকাশ করেন নাই, পাছে পাদরীরা উহা আগুনে পোড়াইয়া ফেলে এবং তাঁহাকেও অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে। প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক কেপ্লার একবার সক্ষোভে লিখিয়াছিলেন,—“আমি আমার গ্রন্থের পাঠকলাভের জন্য একশত বৎসর অপেক্ষা করিতে পারি, কেন না স্বয়ং ভগবান আমার মত একজন সত্যানুসন্ধিৎসার জন্য ছয় হাজার বৎসর অপেক্ষা করিয়াছেন।” ইংলণ্ডের জ্ঞানরাজ্যে নবজাগরণের পর, এলিজাবেথীয় যুগে বহু প্রতিভাশালী কবি এবং গদ্য সাহিত্যের স্রষ্টাই কেবল জন্মগ্রহণ করেন নাই, আধুনিক বিজ্ঞানের বিখ্যাত প্রবর্তকও অনেকে ঐ সময়ে আবির্ভূত হইয়াছিলেন। গিলবার্ট ডাক্তারী করিয়া জীবিকার্জন করিতেন, এবং অবসর সময়ে বিদ্যুৎে সম্বন্ধে গবেষণা করিতেন। হার্ভে রক্তসঞ্চালনের তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। ফ্র্যান্সিস বেকনের কৃতিত্ব অতিরঞ্জিত হইলেও, তাঁহাকে নূতন বৈজ্ঞানিক প্রণালীর প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়।
প্যারাসেলসাস (১৪৯৩-১৫৪১) ধাতুঘটিত ঔষধের ব্যবস্থা দিয়া রসায়ন বিজ্ঞানের চর্চায় উৎসাহ দিয়াছিলেন, সন্দেহ নাই। তাঁহার সময় হইতে রসায়ন বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতি হইতে থাকে এবং চিকিৎসা শাস্ত্রের অধীনতা পাশ হইতে মুক্ত হইয়া ইহা একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান রূপে গণ্য হয়। এগ্রিকোলার (১৪৯৪—১৫৫৫) ধাতুবিদ্যা এবং খনিবিদ্যা সম্বন্ধীয় গ্রন্থ De Re Metallica দ্বারা ব্যবহারিক রসায়নশাস্ত্রের যথেষ্ট উন্নতি হইয়াছে।
কিন্তু ভারতের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্নপ্রকার। হিন্দু জাতি প্রায় সহস্রাধিক বৎসর জীবন্মৃত অবস্থায় ছিল। ধর্মের সজীবতা নষ্ট হইয়াছিল এবং লোকে কতকগুলি বাহ্য আচার অনুষ্ঠান লইয়াই সন্তুষ্ট ছিল। দুই হাজার বৎসর পূর্বে ঐ সকলের হয়ত কিছু উপযোগিতা ছিল, কিন্তু এ যুগে আর নাই। হিন্দুর মস্তিষ্ক সুপ্ত ও জড়বৎ হইয়া ছিল। আমাদের পূর্বপুরষদের মৌলিক চিন্তাশক্তি নষ্ট হইয়া গিয়াছিল এবং তাঁহারা কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধভাবে নবদ্বীপের রঘুনন্দন কর্তৃক ব্যাখ্যাত শাস্ত্রের অনুসরণ করিতেছিলেন। জাতিভেদ প্রথা হিন্দু সমাজে শিকড় গাড়িয়া বসিয়াছিল। এই সমস্ত কারণে আমাদের জাতির মনোভাবের পরিবর্তন হইয়া বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা জাগ্রত হইতে বহু সময় লাগিয়াছিল।
গত শতাব্দীর সত্তরের কোঠায় ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার মহাশয় দেশপ্রেমিক ধনী ব্যক্তিদের নিকট হইতে অর্থসংগ্রহ করেন এবং “ভারত বিজ্ঞান অনুশীলন সমিতি” (Indian Association for the Cultivation of Science) প্রতিষ্ঠিত করেন। সন্ধ্যাকালে ঐ সমিতির গৃহে রসায়ন বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান এবং পরে উদ্ভিদ বিদ্যা সম্বন্ধে বক্তৃতার ব্যবস্থা হয়। প্রথমে এই সমিতিকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত করিবার অভিপ্রায় ছিল না। যে কেহ কিছু দক্ষিণা দিলে সমিতিগৃহে যাইয়া পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন বিজ্ঞান সম্বন্ধে বক্তৃতা নিতে পারিত। সমিতির প্রথম অবৈতনিক বক্তাদের মধ্যে ডাঃ মহেন্দ্ররাল সরকার, ফাদার লার্ফো এবং তারাপ্রসন্ন রায় ছিলেন। ১৮৮০-৮১ সালে আমি প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন বিজ্ঞানের ক্লাসে ভর্তি হইলেও, অধিকতর জ্ঞানলাভের জন্য ঐ দুই বিষয়ে সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশানের বক্তৃতা শুনিবার জন্য যোগদান করিয়াছিলাম। কিন্তু যে কোন কারণেই হোক, ডাঃ সরকারের চেষ্টা তেমন সফল