পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০৪
আত্মচরিত

 ১৮৯৬ সালে কলিকাতার ভারতীয় জাতীয় মহাসমিতির দ্বাদশ অধিবেশন হয়। উহাতে স্বর্গীয় আনন্দমোহন বসু নিম্নলিখিত প্রস্তাব উপস্থিত করেন;—“এই কংগ্রেস ভারত সচিবের অনুমোদিত শিক্ষাবিভাগের পুনর্গঠন ব্যবস্থার প্রতিবাদ করিতেছে। যেহেতু ইহার উদ্দেশ্য ভারতবাসীকে শিক্ষাবিভাগের উচ্চস্তর হইতে বঞ্চিত করা।” আনন্দমোহন এই প্রস্তাব উপলক্ষে যে সারগর্ভ বক্তৃতা করেন, তাহার সংক্ষিপ্ত অনুবাদ দিতেছি।

 “এই প্রস্তাবের প্রবর্তকদিগকে আমি বলিতে চাই যে, তাঁহারা অত্যন্ত অসময়ে দেশের শিক্ষা বিভাগে এইরূপ অধোগতিসূচক নীতি অবলম্বন করিয়াছেন। যদি মহারাণীর ঘোষণার মহৎ বাণী অবজ্ঞা করিতেই হয়—জাতিবর্ণ নির্বিশেষে সকল প্রজার প্রতি সমব্যবহার করিবার যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়াছিলেন, তাহা যদি ভঙ্গ করিতেই হয়, তাহা হইলে তাঁহার রাজত্বের ষষ্টিতম বার্ষিক উৎসবের বৎসরে উহা করা উচিত ছিল না। মহারাণীর উদার শাসনের ষষ্টিতমবর্ষে এই নিকৃষ্ট নীতি প্রবর্তন করা অত্যন্ত অদূরদর্শিতার কার্য হইবে। আর একটি কারণে আমি বলিতেছি এই বৎসরে এরূপ অশোভন চেষ্টা করা তাঁহাদের পক্ষে উচিত হয় নাই। ‘লণ্ডন টাইমস’ সে দিন বলিয়াছেন ১৮৯৬ সাল ভারতের প্রতিভার ইতিহাসে নবযুগের সূচনা করিয়াছে। আমরা সকলেই জানি একজন বিখ্যাত ভারতীয় অধ্যাপকের অদৃশ্য আলোকের ক্ষেত্রে—তথা ইথর তরঙ্গের রাজ্যে— অপূর্ব গবেষণা ইংলণ্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক লর্ড কেলভিনেরও বিস্ময় ও প্রশংসা অর্জন করিয়াছে। আমাদের আর একজন স্বদেশবাসী গত সিভিল সার্ভিস প্রতিযোগিতা পরীক্ষায় অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করিয়াছেন। আমরা আরও জানি যে, রাসায়নিক গবেষণার ক্ষেত্রে আমাদের আর একজন স্বদেশবাসীর প্রতিভা ও অধ্যবসায় বৈজ্ঞানিক জগতে সমাদর লাভ করিয়াছে। সুতরাং বর্তমান বৎসরে প্রমাণ হইয়াছে যে, ভারত তাহার অতীত গৌরবের অবদান বিস্মৃত হয় নাই,—সে তাহার ভবিষ্যতের মহৎ সম্ভাবনা সম্বন্ধে সম্যক্ সচেতন হইয়াছে এবং পাশ্চাত্য মনীষীরাও তাহার এই দাবী স্বীকার করিয়া লইয়াছেন। আর এই বৎসরই এইরূপ নিকৃষ্ট নীতি প্রবর্তনের কি যোগ্য সময়? আমরা বিনা প্রতিবাদে এইরূপ ব্যবস্থা কখনই মানিয়া লইব না। ভদ্রমহোদয়গণ, এই ভাবে বর্ণ-বৈষম্যমূলক নূতন অপরাধ সৃষ্টি করা ও মহারাণীর উদার ঘোষণার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়।

 “ভদ্রমহোদয়গণ, আমি আর একটা কথা বলিতে ইচ্ছা করি। আমি এই অবনতিসূচক অ-ব্রিটিশ কার্য-নীতির কথা আলোচনা করিয়াছি, সুতরাং সরকারী ইস্তাহারে উল্লিখিত কয়েকটি শব্দের প্রতি আপনাদের মনোযোগ বিশেষভাবে আকৃষ্ট করা আমি প্রয়োজন মনে করি। সেই শব্দগুলি এই—‘অতঃপর যে সমস্ত ভারতবাসী শিক্ষাবিভাগে প্রবেশ করিতে ইচ্ছা করিবেন, তাঁহারা সাধারণতঃ ভারতবর্ষে এবং প্রাদেশিক শিক্ষাবিভাগে নিযুক্ত হইবেন।’ এই সরকারী প্রস্তাবের রচয়িতাগণ হয়ত মনে করিয়াছেন যে, ‘সাধারণতঃ’ এই শব্দের একটা বিশেষ গুণ আছে। কিন্তু এই ‘সাধারণতঃ’ শব্দের পরিণাম কি হইবে, তৎসম্বন্ধে আমি ভবিষ্যদ্‌বাণী করিতে চাই। আমি যে ভবিষ্যদ্‌বক্তার শক্তি পাইয়াছি, তাহা নহে। কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতা হইতেই ভবিষ্যৎ অনুমান করা যায় এবং বহু অজ্ঞাত বিষয় স্পষ্ট হইয়া উঠে। সেই অতীতের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমরা মিলাইয়া দেখিব। আমি পূর্বেই বলিয়াছি যে, বাংলাদেশের কথাই আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করিতেছি এবং সেই বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে আমরা কি দেখিতেছি? আমি সভার শোতৃগণকে দূর অতীতে লইয়া যাইব না। কিন্তু কংগ্রেসের জন্মের পর হইতে বর্তমান সময় পর্যন্ত কি ঘটিয়াছে, তাহা আলোচনা করিলে দেখিতে পাই, গত বার বৎসরের মধ্যে ইউরোপে শিক্ষিত ছয়জন যোগ্য ভারতবাসী