পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
১০৫

শিক্ষাবিভাগে নিযুক্ত হইয়াছেন। এই ছয়জন শিক্ষিত ভারতবাসী সকলেই ভারতবর্ষেই কার্যে নিযুক্ত হইয়াছেন। তাঁহারা যে ইংলণ্ডে নিয়োগলাভ করিতে চেষ্টা করেন নাই, তাহা নহে। এই ছয়জন ভারতবাসী ব্রিটিশ ও স্কচ বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে উপাধিলাভ করিয়া এবং বিশেষ যোগ্যতার পরিচয় দিয়া (যে সমস্ত ইংরাজ শিক্ষাবিভাগে আছেন, তাঁহাদের অপেক্ষা ইঁহাদের যোগ্যতা কোন অংশেই কম নহে, বরং কোন কোন ক্ষেত্রে বেশি) ইংলণ্ডে ভারতসচিবের দপ্তর হইতে নিয়োগলাভ করিতে প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহাদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়। বহুদিন অধীরহৃদয়ে অপেক্ষা করিবার পর তাঁহাদিগকে সত্বর ভারতে প্রত্যাবর্তন করিতে এবং সেইখানেই গবর্ণমেণ্টের নিকট কাজের চেষ্টা করিতে বলা হইল। সুতরাং এই ‘সাধারণতঃ’ শব্দ থাকা সত্ত্বেও, অতীতে যাহা হইয়াছে, ভবিষ্যতেও যে তাহা হইবে, ইহা অনুমান করা কঠিন নহে। বর্তমানে যে অবনতিসূচক ধারাটি নির্দেশ করা হইয়াছে, তাহা পূর্বে না থাকা সত্ত্বেও কার্যতঃ এইরূপে ঘটিয়াছে। সতরাং ভদ্রমহোদয়গণ, আপনারা ধরিয়া লইতে পারেন যে ‘সাধারণতঃ’ শব্দের অর্থ এখানে ‘অপরিহার্যরূপে’, এবং আমাদের দেশবাসীর পক্ষে এখন শিক্ষাবিভাগের উচ্চস্তরে প্রবেশের দ্বার রুদ্ধ।

 “আমি আর বেশিক্ষণ বলিতে চাই না, আমার বক্তৃতা করিবার নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হইয়াছে। আমি কেবল একটি কথা বলিয়া আমার বক্তব্য শেষ করিব। কংগ্রেসের সদস্যগণের নিকট শিক্ষার চেয়ে প্রিয় বিষয় আর কিছু হইতে পারে না—ভদ্রমহোদয়গণ, আপনারাই সেই শিক্ষার ও জাতীয় মনের মহৎ জাগরণের ফলস্বরূপ। ইহা কি সম্ভব যে, আমাদের ভারত ও ইংলণ্ডস্থিত বন্ধুদের তথা সকল স্থানের মানব সভ্যতার উন্নতিকামীগণের সাহায্যে যাহাতে আমাদের স্বদেশবাসিগণ শিক্ষাবিভাগের উচ্চস্তর হইতে বহিষ্কৃত না হয়, তজ্জন্য আপনারা যথাসাধ্য চেষ্টা করিবেন না? ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে ভারতবাসীদের নিয়োগের বিরুদ্ধে যে সমস্ত কথা বলা হইয়া থাকে, সত্য হোক মিথ্যা হোক, সেই সমস্ত কথা শিক্ষাবিভাগের সম্বন্ধে খাটে না। সুতরাং এই ব্যাপক বহিষ্কার নীতির পক্ষে কি যুক্তি থাকিতে পারে? ভদ্রমহোদয়গণ, আমি ভারতের প্রতিভায় বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি যে, কয়েক শতাব্দী পূর্বে ভারতে যে বহ্নি প্রজ্বলিত হইয়াছিল, তাহা এখনও সম্পূর্ণরূপে নির্বাপিত হয় নাই। আমি বিশ্বাস করি, সেই বহ্নির স্ফুলিঙ্গ এখনও বর্তমান এবং তাহাকে সহানভূতির বাতাস দিলে এবং যত্ন করিলে আবার গৌরবময় জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হইতে পারে। সেই প্রদীপ্ত বহ্নি অতীতে কেবল ভারতে নয় জগতের সর্বত্র জ্যোতিঃ বিকীরণ করিয়াছিল এবং শিল্প, সাহিত্য, গণিত, দর্শনের আশ্চর্য সৃষ্টি করিয়াছিল, যাহা এখন পর্যন্ত জগতের বিস্ময় উৎপাদন করিতেছে। এখনও চেষ্টা করিলে তাহার পুনরাবির্ভাব হইতে পারে। এই মহৎ উদ্দেশ্যে আপনারা দ্বিগুণ উৎসাহে সংগ্রাম করুন এবং তাহা হইলে ভগবানের কৃপায়, ন্যায় ও নীতি জয়যুক্ত হইবে এবং এই প্রাচীন দেশের অধিবাসীদের ললাটে যে কলঙ্কের ছাপ অঙ্কিত করিবার চেষ্টা হইতেছে, তাহা ব্যর্থ হইবে।”

 এস্থলে আমি একটি ঘটনার উল্লেখ করিব, যাহা আমার ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। বহু প্রত্যাশিত “পুনর্গঠন ব্যবস্থা” ভারত সচিব কর্তৃক অবশেষে অনুমোদিত হইল এবং আমি শিক্ষা বিভাগের নির্দিষ্ট “গ্রেডে” স্থান লাভ করিলাম। আমি উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন সিনিয়র অফিসার ছিলাম,—এইজন্য আমাকে আমার কর্মক্ষেত্র প্রেসিডেন্সি কলেজ ত্যাগ করিয়া রাজসাহী কলেজের অধ্যক্ষ পদ গ্রহণ করিতে বলা হইল। একটি প্রথম শ্রেণীর কলেজের অধ্যক্ষপদ এবং বিনা ভাড়ার কলেজের সংলগ্ন