১৯০৮ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে একটি স্মরণীয় অনুষ্ঠান হইল। লর্ড ক্যানিং ১৮৫৮ সালে কলিকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সনন্দ দেন। ১৯০৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চাশৎ বার্ষিক জুবিলী উৎসব মহাসমারোহে সম্পন্ন হইল এবং কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে সম্মানসূচক উপাধি প্রদত্ত হইল; ইঁহাদের মধ্যে আমিও ছিলাম।
এই সময়ে আমার মনে হইল যে “হিন্দু রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাসের” প্রতিশ্রুত দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ করা আমার পক্ষে কর্তব্য। তদনুসারে আমি তন্ত্র সম্বন্ধে কতকগুলি নূতন সংগৃহীত পুঁথি পাঠ করিতে লাগিলাম। সৌভাগ্যক্রমে ডাঃ ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের সহযোগিতা লাভেও আমি সমর্থ হইলাম। ডাঃ শীলের জ্ঞান সর্বতোমুখী, তিনি প্রাচীন হিন্দুদের ‘পরমাণু তত্ত্ব’ সম্বন্ধে একটি অধ্যায় লিখিয়া দিলেন। এই অংশ পরে সংশোধিত ও পরিবর্দ্ধিত করিয়া ডাঃ শীল তাঁহার “Positive Sciences of the Ancient Hindus” নামক বিখ্যাত গ্রন্থে প্রকাশ করেন।
দ্বিতীয় খণ্ডের ভূমিকা হইতে নিম্নোদ্ভূত কয়েক পংক্তি পড়িলেই বুঝা যাইবে, আমার এই স্বেচ্ছাকৃত দায়িত্ব ভার হইতে মুক্ত হইয়া আমার মনোভাব কিরূপ হইয়াছিল। বলা বাহুল্য, এই গুরুতর কর্তব্য পালন করিতে যে কঠোর পরিশ্রম করিতে হইয়াছিল, তাহা আমার পক্ষে প্রীতি ও আনন্দপ্রদই ছিল। “গত ১৫ বৎসরেরও অধিককাল ধরিয়া আমি যে কর্তব্য পালনে নিযুক্ত ছিলাম, তাহা হইতে বিদায় গ্রহণ করিবার সময়ে আমার মনে যুগপৎ হর্ষ ও বিষাদ জাগ্রত হইতেছে। রোমক সাম্রাজ্যের ইতিহাসকারের মনে যেরূপ ভাবের উদয় হইয়াছিল, ইহা অনেকটা সেইরূপ। সুতরাং যদি এডমণ্ড গিবনের ভাষায় আমি আমার মনোভাব ব্যক্ত করি পাঠকগণ আমাকে ক্ষমা করিবেন। ‘এই কার্য হইতে অবশেষে মুক্তিলাভ করিয়া আমার মনে যে আনন্দ হইতেছে, তাহা আমি গোপন করিতে চাই না।.......কিন্তু আমার গর্ব শীঘ্রই খর্ব হইল, যে কার্য আমার পুরাতন সঙ্গী ছিল এবং আমাকে দীর্ঘ কাল ধরিয়া আনন্দ দান করিয়াছে, তাহার নিকট হইতে চিরবিদায় গ্রহণ করিতে হইবে, এই ভাবনায় একটা শান্ত বিষাদ আমাকে আচ্ছন্ন করিল।’
“হিন্দুর অতীত গৌরবময়, তাহার অন্তরে বিরাট শক্তির বীজ নিহিত আছে, সতরাং তাহার ভবিষ্যৎ আরও গৌরবময় হইবে, আশা করা যাইতে পারে, এবং যদি এই ইতিহাস পড়িয়া আমার স্বদেশবাসীদের মনে জগৎসভায় তাহাদের অতীত গৌরবের আসন লাভ করিবার ইচ্ছা জাগ্রত হয়, তাহা হইলেই আমার পরিশ্রম সার্থক হইবে।” অধ্যাপক সিল্ভাঁ লেভি ‘হিন্দু রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাসের’ দ্বিতীয় খণ্ড সমালোচনা প্রসঙ্গে বলেন—“তাঁহার গবেষণাগার ভারতের নব্য রাসায়নিকগণের সূতিকা গৃহ। অধ্যাপক রায় সংস্কৃত বিদ্যায় পারদর্শী। ......পাশ্চাত্যের ভাষা সমূহেও তাঁহার দখল আছে,—ল্যাটিন, ইংরাজী, জার্মান ও ফরাসী ভাষায় লিখিত গ্রন্থাবলীর সঙ্গে তাঁহার ঘনিষ্ঠ পরিচয়।”
রসায়ন শাস্ত্রের চর্চায় আমার সমস্ত শক্তি ও সময় নিয়োগ করিবার অবসর আমি পুনর্বার লাভ করিলাম। প্রেসিডেন্সি কলেজ লেবরেটরি হইতে যে সমস্ত মৌলিক গবেষণামমূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হইয়াছে, তাহার সূচী পড়িলেই যে কেহ দেখিতে পাইবেন, ঐ সময় হইতে কতকগুলি প্রবন্ধ আমার ও আমার সহকর্মী ছাত্রদের যুগ্ম নামে প্রকাশিত হইতে থাকে। পরে এই রীতিই প্রধান হইয়া উঠে। অন্য কাহাকেও সহকর্মী করা হইলে তাঁহার উপরে পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করাই উচিত এবং কার্যের ফলভোগী হইবার সুযোগও তাঁহাকে দেওয়া উচিত। সহকর্মী শীঘ্রই প্রধান কর্মীর সঙ্গে আপনার লক্ষ্যকে একীভূত