পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১২
আত্মচরিত

কলেজে ছাত্ররূপে প্রবেশ করিতে পারিলেন না, সুতরাং ‘জাতীয় শিক্ষাপরিষদের’ রাসায়নিক লেবরেটরিতে কিছুদিন কাজ করিতে লাগিলেন। ব্যবহারিক রসায়ন বিজ্ঞান তাঁহার বিশেষ প্রিয় ছিল। কয়েকখণ্ড পরিত্যক্ত কাচের নল হইতে তিনি এমন সব যন্ত্র তৈরী করিতে পারিতেন যাহা এতদিন জার্মানি বা ইংলণ্ডের কোন ফার্ম হইতে আনাইতে হইত। জনৈক বন্ধু তাঁহার কৃতিত্ব ও দক্ষতার কথা আমাকে জানান। আমি তাঁহাকে ডাকিয়া পাঠাইলাম এবং শীঘ্রই বুঝিতে পারিলাম তিনি একজন দুর্লভ গুণসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক কর্মী। ‘অ্যামাইন নাইট্রাইট্‌সের’ সংশ্লেষণ কার্যে তিনি আমার সহায়তা করিয়াছিলেন। তিনি অনেক সময় একাদিক্রমে ৯ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করিতেন। শীতের দেশে ইহা সাধারণ হইলেও এই অসহ্য গ্রীষ্মের দেশে বড়ই কঠিন কাজ। তিনিও শীঘ্রই মৌলিক গবেষণায় যোগ্যতার পরিচয় দিলেন এবং তাহার ফলে সরকারী আফিম বিভাগে বিশ্লেষক রূপে প্রবেশ করিলেন।

 ১৯১০-১১ সালে আমার একটি অপূর্ব অভিজ্ঞতা হয়। বর্ষার সময়ে বাংলার নিম্নাংশের অনেকখানি বন্যার জলে প্লা‌বিত হয়। সাধারণতঃ এই বন্যাপ্লাবিত স্থানগুলি ম্যালেরিয়া হইতে মুক্ত থাকে। বস্তুতঃ, এরূপ দেখা গিয়াছে যে, যেস্থানে বেশী বন্যার প্লাবন হয়, সেই স্থানগুলিই ম্যালেরিয়ার আক্রমণ হইতে নিষ্কৃতি পায়। কতকগুলি স্থানে বন্যা হয় না কিন্তু উপযুক্ত জলনিকাশের অভাবে খানা ডোবা খাল পুকুর প্রভৃতিতে রুদ্ধ জল জমিয়া থাকে। বর্ষার শেষে এই সমস্ত রুদ্ধ জলাশয় ম্যালেরিয়াবাহী মশকের জন্মস্থান হইয়া দাঁড়ায়, পচা গাছপালা উদ্ভিজ্জ হইতে একরকম বিষাক্ত গ্যাসও বাহির হইতে থাকে। বরাবর আমার একটা নিয়ম এই ছিল যে, আমি গ্রীষ্মাবকাশের কতকাংশ (মে মাসে) আমার গ্রামে কাটাইতাম। ইহার দ্বারা আমি পল্লীজীবনের আনন্দ উপভোগ করিতে পারিতাম এবং গ্রামবাসী ও কৃষকদের সঙ্গেও আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হইত। ঐ বৎসর (১৯১০-১১) দৈবক্রমে বর্ষা একটু আগেই হইয়াছিল। আমাদের গ্রামের স্কুলের পুরস্কার বিতরণী সভায় যোগদান করিবার জন্য আমি ১৫ই জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করিলাম। পরদিনই আমি কলিকাতা যাত্রা করিলাম এবং কলিকাতা পৌঁছিয়াই ম্যালেরিয়ার পালাজ্বরে আক্রান্ত হইলাম। এক বৎসর এইভাবে কাটিল। চিররুগ্ন ব্যক্তির পক্ষে এইরূপ ম্যালেরিয়া জ্বরের আক্রমণ বেশীদিন সহ্য করা কঠিন। বন্ধুগণ আমার স্বাস্থ্যের জন্য উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন এবং ডাঃ নীলরতন তাঁহার দার্জিলিঙের বাড়ীতে আমাকে পাঠাইলেন, সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যহ তিনবার করিয়া কুইনাইন সেবন করিবার ব্যবস্থাও করিয়াছিলেন। দার্জিলিঙের স্বাস্থ্যকর জলবায়ুতে আমার শরীর ভাল হইল। এই ঘটনাটি আমি প্রায় বিস্মৃত হইয়াছিলাম। কিন্তু বাংলা বৈজ্ঞানিক মাসিক পত্রিকা “প্রকৃতি”তে একখানি পুরাতন পত্র প্রকাশিত হওয়াতে এই ঘটনা আমার মনে পড়িয়াছে। পত্রখানি উদ্ধৃত করিতেছি।

দার্জ্জিলিং, প্লেন ইডেন
১৪।৬।১১

প্রিয় জিতেন,

 তোমার ১২ই তারিখের পত্র পাইয়া আনন্দিত হইলাম। আমিই তোমার কাজ সম্বন্ধে জানিবার জন্য তোমাকে পত্র লিখিব বলিয়া মনে করিতেছিলাম। হেমেন্দ্রকে তুমি বলিতে পার যে, ‘মেখিল ইথর’ সম্বন্ধে তাহার গবেষণা যোগ্য সমাদর লাভ করিবে।

 আহত সেনাপতি দূর হইতে যেমন দেখেন ভীষণ যুদ্ধ হইতেছে এবং তাঁহার বিজয়ী সৈন্যগণ অভিযান করিতেছে, আমার মনের ভাবও কতকটা সেইরূপ। ভগবানের কৃপায়