পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
১১৭

করিয়াছেন—কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভাইস-চ্যান্সেলর—যিনি উপর্যুপরি বড়লাট কর্তৃক ভাইস-চ্যান্সেলর মনোনীত হইয়াছেন—সেই স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট।

 “মাননীয় সভাপতি মহাশয়, আমি আসন গ্রহণ করিবার পূর্বে পুনর্বার আমাদের দেশের কলেজসমূহে যে শিক্ষা দেওয়া হয়, আপনাদিগকে তাহার অধিকতর সমাদর করিতে অনুরোধ করিতেছি।”

 আমার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় সুফল হইয়াছিল, মনে হয়। অধিবেশন শেষ হইলে, মাষ্টার অব্ ট্রিনিটি ডাঃ বাটলার সর্বাধিকারী ও আমার সঙ্গে পরিচয় করিলেন এবং বলিলেন, কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করিবার সময় আমরা যেন তাঁহার অতিথি হই।

 আমি প্রথমেই এই ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয় (কেম্ব্রিজ) দেখিতে গেলাম। সর্বাধিকারী আমার একদিন পূর্বে গিয়াছিলেন। আমি কেম্ব্রিজে পৌছিলে, সর্বাধিকারীকে সঙ্গে করিয়া মাষ্টার অব ট্রিনিটি ষ্টেশনে আসিলেন এবং আমাকে গাড়ীতে করিয়া তাঁহার বাড়ীতে লইয়া গেলেন। কিছু জলযোগের পর তিনি আমাদিগকে ট্রিনিটি কলেজের একটি ছোট ঘরে লইয়া গেলেন। ঘরটি একটি ছোটখাট মিউজিয়মের মত, বহু প্রাচীন ও মূল্যবান নিদর্শন সেখানে রক্ষিত আছে। আমার যতদূর মনে হয়, ‘লালে গ্রো’র (L’ Allegro) পাণ্ডুলিপির কয়েকপাতা আমি সেখানে দেখিয়াছি। বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক নিউটন যে সমস্ত যন্ত্রপাতি লইয়া জ্যোতিষ ইত্যাদি সম্বন্ধে গবেষণা করিয়াছিলেন, তাহাও একটি মানমন্দির বা গবেষণাগারে রক্ষিত আছে।

 ডাঃ বাটলার প্রাচীন সাহিত্যে সুপণ্ডিত, মধুর প্রকৃতির লোক। তাঁহাকে দেখিয়া আমাদের দেশের প্রাচীন পণ্ডিতদের কথা আমার মনে পড়িল। তিনি গল্প করিলেন, সেকালে জজেরা যখন কেম্ব্রিজে আদালত বসাইতেন, তাঁহাদের দলবল ট্রিনিটি কলেজের রসুইখানা ইত্যাদি দখল করিয়া লইত। আমার বিশ্বাস, এখনও ঐ প্রাচীন প্রথা আছে। ইংলণ্ডের রাজা এখনও প্রতি বৎসর যখন কেম্ব্রিজে ‘রিভিউ’ দেখিতে আসেন, তখন তিনি ট্রিনিটি কলেজের অতিথি হন। মাষ্টার আমাদের থাকিবার জন্য ঘর ঠিক করিয়াছিলেন এবং সেই সময়ে দেখাইলেন, পাশের একটি ঘর রাজার অভ্যর্থনার জন্য সাজানো হইতেছে।

 বাহির হইতে কংগ্রেসে আগত প্রতিনিধিগণ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করিবার জন্য বাছিয়া লইতে পারেন এবং ঐ সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁহারা অতিথিরূপে গণ্য হন। আমি উত্তর ইংলণ্ডের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় দেখিব ঠিক করিলাম। উহার মধ্যে শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয় একটি। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি অপেক্ষাকৃত নূতন এবং অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ বা এডিনবার্গের মত ইহার তেমন প্রাচীনতার খ্যাতিও নাই। সেজন্য ইহা দেখিবার জন্য কম প্রতিনিধিই যাইতেন। আমার বাল্যকালে শেফিল্ড রজার্সের ছুরি, কাঁচি, ক্ষুর প্রভৃতির কারখানার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল, ঐগুলি বাংলাদেশে সে সময়ে খুব ব্যবহৃত হইত। শেফিল্ড এখন খুব বড় শহর হইয়া উঠিয়াছে, অসংখ্য কলকারখানা এখানে গড়িয়া উঠিয়াছে। সুপ্রসিদ্ধ ভিকার্স ম্যাক্সিন এণ্ড কোম্পানির কারখানা এখানে। শেফিল্ড অতিথিগণের অভ্যর্থনার জন্য বিপুল আয়োজন করিয়াছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে ঐ দিন সকাল বেলায় একমাত্র অতিথি গিয়াছিলাম আমি। একটা কৌতুককর ঘটনা এখনও আমার মনে আছে। ষ্টেশনে নামিলে, পোর্টার আমার মালপত্র একটা টানাগাড়ীতে তুলিয়া লইল এবং বলিল যে কোন ট্যাক্সি ভাড়া করিবার দরকার নাই, কেননা নিকটেই অনেকগুলি হোটেল আছে। আমি কোন্ হোটেলে যাইতে চাই, তাহাও সে জিজ্ঞাসা করিল। আমি