কোন হোটেলের নাম করিতে পারিলাম না,—কেবল সম্মুখের ছোট হোটেল দেখাইয়া দিলাম। পোর্টার গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল—“ও হোটেল আপনার যোগ্য নয়।” আমি তাহার উপরই ভার দিলাম এবং সে আমাকে নিকটবর্তী একটি ফ্যাশনেবল হোটেলে লইয়া গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের আফিসে আমার আগমন সংবাদ দিলে,—সকলেই আমার অভ্যর্থনার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক হিক্স্ এবং সমস্ত অধ্যাপক আমাকে লইয়া গিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ দেখাইলেন। যে হোটেলে আমি ছিলাম, সেখানেই তাঁহারা আমার সম্মানার্থ লাঞ্চের আয়োজন করিলেন। সন্ধ্যার পর একটি চমৎকার অনুষ্ঠান হইল। টাউন হলে বিরাট ভোজের আয়োজন হইল এবং ‘মাষ্টার কাটলার’ আমার এবং কানাডার একজন প্রতিনিধির সম্বর্ধনার প্রস্তাব করিলেন। কানাডার প্রতিনিধিটি অপরাহ্ণের দিকে শেফিল্ডে পৌঁছিয়াছিলেন। সুতরাং সমস্তদিন অতিথিরূপে একমাত্র আমিই রাজোচিত আদর অভ্যর্থনা পাইয়াছিলাম। এই জন্যই বলিয়াছি যে ‘দুর্ভাগ্যক্রমে অতিথিরূপে একমাত্র আমি সকালবেলা শেফিল্ডে গিয়াছিলাম।’ উৎসব অনুষ্ঠান প্রভৃতিতে যোগ দিতে আমার স্বভাবতঃই সঙ্কোচ হয়।
লণ্ডনে “ওয়ারশিপফুল ফিসমঙ্গার্স কোম্পানি” (মৎস্য ব্যবসায়ী) অতিথিদের অভ্যর্থনার জন্য একটি ভোজ দিয়াছিলেন। এই ফিসমঙ্গার্স কোম্পানি এবং ভিণ্টার্স কোম্পানি, মার্চেণ্ট টেলার্স কোম্পানি প্রভৃতি প্রভূত ঐশ্বর্যশালী এবং বহু পুরাতন। এই সব ভোজ এত ব্যয়বহুল যে, ভারতবাসীদের নিকট তাহা রূপকথার মত বোধ হয়। ফিসমঙ্গার্স কোম্পানির একটি ভোজ সভা প্রসঙ্গে মেকলে লিখিয়াছেন—“একবার তাহাদের ভোজে জন প্রতি প্রায় দশ গিনি (১৫০৲ টাকা) ব্যয় হইয়াছিল।” (মেকলের জীবনী, প্রথম খণ্ড, ৩৩৭ পৃঃ)। আর একস্থানে তিনি লিখিয়াছেন, “ভোজের সম্বন্ধে এই কোম্পানিই পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।” (জীবনী, ৩৩৬ পৃঃ)। এই সব কোম্পানির শহরে এবং অন্যান্য স্থানে ভূসম্পত্তি আছে, উহার মূল্য বর্তমানকালে প্রায় সহস্রগুণ বাড়িয়া গিয়াছে। ভোজের খাদ্যদ্রব্যের তালিকায় এগারটি পদ ছিল, প্রথমে ‘সুপ’ এবং প্রত্যেক পদের শেষে উৎকৃষ্ট মদ্য। এইসব মদ্য প্রায় অর্ধশতাব্দী বা তার বেশী মাটীর নীচে পাত্রে রক্ষিত এবং ভোজের সময়ে খোলা হইয়াছিল। এই সব অনুষ্ঠানে বহু প্রাচীন প্রথা অনুষ্ঠিত হয়, যথা “কাপ অব লভের” অনুষ্ঠান। সেকালে এই অনুষ্ঠানের সময়, অতিথিরা অতিরিক্ত মদ্য পান করিয়া পরস্পরের সঙ্গে কলহ করিত। এমনকি পরস্পরকে অস্ত্রদ্বারা আহতও করিত। কাপটি বৃহদাকার, ধাতুনির্মিত। ইহা মদ্যপূর্ণ করা হইত এবং প্রত্যেক অতিথি উহা হইতে একটু মদ্য আস্বাদ করিয়া, তাহার পাশের লোকের হাতে দিত। ইহা শান্তি ও সদিচ্ছার প্রতীক স্বরূপ। আমি মদ্যপান করিনা, সুতরাং কেবল মুখের নিকট তুলিয়া ধরিয়া অন্যের হাতে দিলাম।
কংগ্রেসের অধেবেশনের সমকালে রয়েল সোসাইটির ২৫০তম বার্ষিক উৎসবও হইতেছিল। আমি এই উৎসবেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ হইতে প্রতিনিধিরূপে আসিয়াছিলাম। সুতরাং ইহার কয়েকটি অনুষ্ঠানে আমি যোগ দিয়াছিলাম। লণ্ডনের লর্ড মেয়র রয়্যাল সোসাইটির সদস্যগণ এবং কংগ্রেসের প্রতিনিধিগণকে গিল্ড হলে এই স্মরণীয় ঘটনা উপলক্ষে একটি বিরাট ভোজ দিবার আয়োজন করিলেন। আমিও ঐ ভোজে লর্ড মেয়রের অতিথিরূপে যোগ দিলাম। রাজাও উইণ্ডসর প্রাসাদে অতিথিদের সম্বর্ধনা করিলেন। বহু-বিস্তৃত সবুজ তৃণমণ্ডিত মাঠ এবং বৃক্ষের সারি আমার নিকট বড় মনোরম বোধ হইল।