ভাব, উদার বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা, তর্ক ও আলোচনায় সেই গভীর জ্ঞান, এই সমস্ত গুণ আমরা কোথায় পাইব? গত ৩০ বৎসর ধরিয়া এই সমস্ত দুর্লভ গুণেই আপনি ছাত্রদের প্রীতি অর্জন করিয়াছেন।
“আপনার কৃতিত্ব অসামান্য। আপনার সরল জীবন যাপন প্রণালী আমাদিগকে প্রাচীন ভারতের গৌরবময় যুগকে স্মরণ করাইয়া দেয়। আপনি চিরদিনই আমাদের বন্ধু, গুরু ও পথ-প্রদর্শক ছিলেন। সকলেই আপনার কাছে প্রবেশ করিতে পারে। আপনার প্রকৃতি সর্বদাই মধুর। দরিদ্র ছাত্রদিগকে কেবল সৎপরামর্শ দিয়া নহে, অর্থ দ্বারাও আপনি সহায়তা করিতে সর্বদাই প্রস্তুত। কঠোর ব্রহ্মচর্যপূত অনাড়ম্বর জীবন আপনার, আপনার দেশপ্রেমের বাহ্য আড়ম্বর নাই। কিন্তু উহা গভীর,—আপনার মধ্যে আমরা প্রাচীন ভারতের গুরুর আদর্শেরই পুনরাবির্ভাব দেখিতেছি।
“যখন ভারতের বর্তমান যুগের জ্ঞানোন্নতির ইতিহাস লেখা হইবে, তখন ভারতে নব্য রসায়নী বিদ্যার প্রবর্তক রূপে আপনার নাম সর্বাগ্রে সগৌরবে উল্লিখিত হইবে। এদেশে মৌলিক রাসায়নিক গবেষণার জন্মদাতা এবং বৈজ্ঞানিক ভাবের জন্মদাতারূপে যশ ও গৌরব আপনারই প্রাপ্য। আপনার ‘হিন্দু রসায়নের ইতিহাস’ গ্রন্থ ভারতীয় কীর্তি-মালার এক নূতন অধ্যায় খুলিয়া দিয়াছে ও অতীতের অন্ধকারের উপর আলোকের সেতু রচনা করিয়াছে, এবং তাহার ফলে নবীন বৈজ্ঞানিকগণ প্রাচীন নাগার্জুন ও চরকের সঙ্গে জ্ঞানরাজ্যে মৈত্রী স্থাপনের সংযোগ লাভ করিয়াছেন।
“আপনি এর চেয়েও বেশি করিয়াছেন। রাসায়নিক গবেষণাকে আপনি দেশের প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করিয়াছেন এবং ভারতীয় বিজ্ঞান ও শিল্প প্রচেষ্টা বাহিরের সাহায্য নিরপেক্ষ হইয়াও কিরূপে সাফল্য লাভ করিতে পারে, বেঙ্গল কেমিক্যাল ও ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস, তাহার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
“জীবন সায়াহ্নে লোকে সাধারণতঃ যখন অবসর অন্বেষণ করেন, তখনও আপনি কার্যক্ষেত্রে থাকিতেই সঙ্কল্প করিয়াছেন। এক যুগ পূর্বে আপনি যে বিজ্ঞানের আলোক প্রজ্জ্বলিত করিয়াছিলেন, তাহা অনির্বাণ রাখিবার জন্য আপনি আগ্রহান্বিত। বিজ্ঞান কলেজ এবং রাসায়নিক গবেষণা যেন দীর্ঘকাল ধরিয়া আপনার অক্লান্ত সেবা ও উৎসাহে শক্তি লাভ করে। আপনার আশীর্বাদে আরও বহু বিজ্ঞান অনুসন্ধিৎসু যেন এই পথে অগ্রসর হয় এবং আমরা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রগণ ও পরবর্তীগণ যেন আপনার উদার স্নেহপ্রবণ হৃদয়ের ভালবাসা হইতে বঞ্চিত না হই।” এই বিদায় সম্বর্ধনা সত্যই বেদনাদায়ক! মানুষ যখন আত্মীয় স্বজনের শোকাশ্রুর মধ্যে ইহলোক হইতে বিদায় গ্রহণ করে সেইদিনের কথা ইহাতে স্মরণ হয়। আবেগকম্পিতকণ্ঠে গভীর বাষ্পরুদ্ধ স্বরে আমি ইহার উত্তর দিলাম:—
“সভাপতি মহাশয়, আমার সহকর্মিগণ এবং তরুণ বন্ধুগণ,
“আপনারা যে ভাবে আমার প্রতি উচ্চপ্রশংসাসূচক বাক্য প্রয়োগ করিয়াছেন, তাহাতে আমি কুণ্ঠিত ও অভিভূত হইয়া পড়িয়াছি। সতরাং যদি মনের রুদ্ধ ভাব আমি যথোচিত প্রকাশ না করিতে পারি, আপনারা আমাকে ক্ষমা করিবেন। আমি জানি, এইরূপে বিদায় সম্বর্ধনার ক্ষেত্রে আপনারা আমার বহু ত্রুটী বিচ্যুতি ক্ষমা করিবেন এবং আমার মধ্যে যদি কিছু ভাল দেখিয়া থাকেন, তাহারই উপর জোর দিবেন। ভদ্র মহোদয়গণ, আমি ইহা ভগবানের নির্দেশ বলিয়া মনে করি যে আমার বন্ধু ও সহকর্মী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু ও আমি গত ত্রিশ বৎসর ধরিয়া এক সঙ্গে কাজ করিয়াছি। আমরা প্রত্যেকে