পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ
১২৫

আমাদের স্বতন্ত্র বিভাগে কাজ করিয়াছি, পরস্পরকে উৎসাহ দান করিয়াছি, এবং আমি আশা করি যে আমরা যে অগ্নি মৃদুভাবে প্রজ্জ্বলিত করিয়াছি, তাহা ছাত্রপরম্পরাক্রমে অধিকতর উজ্জ্বল ও জ্যোতির্ময় হইতে থাকিবে এবং অবশেষে তাহা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে আলোকিত করিবে। আপনাদের কেহ কেহ হয়ত জানেন যে যাহাকে পার্থিব বিষয় সম্পত্তি বলে, তাহার প্রতি আমি কোন দিন বিশেষ মনোযোগ দিই নাই। যদি কেহ আমাকে জিজ্ঞাসা করেন যে প্রেসিডেন্সি কলেজে আমার কার্যকাল শেষ হইবার সময় আমি কি মূল্যবান সম্পত্তি সঞ্চয় করিয়াছি, তাহা হইলে প্রাচীন কালের কর্ণেলিয়ার কথায় আমি উত্তর দিব। আপনারা সকলেই সেই আভিজাত্য-গৌরব-শালিনী রোমক মহিলার কাহিনী শুনিয়াছেন। জনৈক ধনী গৃহিণী একদিন তাঁহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে আসিয়া নিজের রত্ন অলঙ্কার প্রভৃতি সগর্বে দেখাইলেন এবং কর্ণেলিয়াকে তাঁহার নিজের রত্নালঙ্কার দেখাইবার জন্য অনুরোধ করিলেন। কর্ণেলিয়া বলিলেন—‘আপনি একট অপেক্ষা করুন, আমার মণি-মাণিক্য আমি দেখাইব।’ কিছুক্ষণ পরে কর্ণেলিয়ার দুই পত্রে বিদ্যালয় হইতে ফিরিলে তিনি তাহাদিগকে দেখাইয়া সগর্বে বলিলেন,—‘এরাই আমার রত্নালঙ্কার।’ আমিও কর্ণেলিয়ার মত, রসিকলাল দত্ত, নীলরতন ধর, মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখার্জী প্রভৃতিকে দেখাইয়া বলিতে পারি, ‘এরাই আমার রত্ন।’ ভদ্রমহোদয়গণ, আপনাদের কলেজ ম্যাগাজিনের বর্তমান সংখ্যায় ‘প্রেসিডেন্সি কলেজের শতবার্ষিকী’ নামক যে প্রবন্ধ আমি লিখিয়াছি, তাহাতে আমি দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি, আপনাদের এই কলেজ নব্য ভারত গঠনে কি মহান্ অংশ গ্রহণ করিয়াছে। আমি আশাকরি, আপনারা কলেজের এই গৌরব রক্ষা করিবেন।

 “ভদ্রমহোদয়গণ, প্রেসিডেন্সি কলেজের সঙ্গে আমি সম্বন্ধ ছিন্ন করিতেছি, এ চিন্তা করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমার জীবনের সমস্ত গৌরবময় স্মৃতি ইহার সঙ্গে জড়িত; এই রাসায়নিক গবেষণাগারের প্রত্যেক অংশ, ইহার ইঁট চুন-সুরকী পর্যন্ত অতীতের স্মৃতিপূর্ণ। আরও যখন মনে পড়ে যে আমার বাল্যজীবনের চার বৎসর ইহারই শাখা হেয়ার স্কুলে আমি কাটাইয়াছি এবং পরে চার বৎসর এই কলেজেই পড়িয়াছি, তখন দেখিতে পাই, এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ দীর্ঘ ৩৫ বৎসর কালব্যাপী। এবং আমার মৃত্যুকালে এই ইচ্ছাই আমার মনে জাগরূক থাকিবে যে, আমার চিতাভস্মের এক কণা যেন এই পবিত্রভূমির কোথাও রক্ষিত থাকে। ভদ্রমহোদয়গণ, আমার আশঙ্কা হইতেছে, বক্তৃতায় যেটুকু বলিতে ইচ্ছা করিয়াছিলাম,—তাহার সীমা আমি অতিক্রম করিয়াছি। আপনাদের চিত্তাকর্ষক অভিনন্দনের জন্য হৃদয়ের অন্তঃস্থল হইতে ধন্যবাদ দিতেছি। আপনাদের এই অনুষ্ঠানের স্মৃতি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমি বহন করিব।”

 এখানে পরলোকগত ডাঃ ই, আর, ওয়াটসনের স্মৃতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা কর্তব্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপকরূপে, তিনি একদল নবীন রাসায়নিক গড়িয়া তুলিয়াছিলেন এবং তাহাদের প্রাণে মহৎ অনুপ্রেরণা জাগাইয়াছিলেন।

 “১৯০৮ সালে ঢাকা কলেজ হইতে প্রথম একদল ছাত্র রসায়নশাস্ত্রে এম, এ, পরীক্ষায় পাশ করে। ডাঃ ওয়াটসন অনকূলচন্দ্র সরকার নামক কৃতী ছাত্রকে বাছিয়া লন এবং তাঁহার সহযোগিতায় গবেষণা করিতে থাকেন। পরে আরও দুইজন ছাত্র এই কার্যে যোগ দিয়াছেন। ঢাকা কলেজে রাসায়নিক গবেষণার ইহাই আরম্ভ। তাহার পর হইতে ডাঃ ওয়াটসনের কানপুর গমন পর্যন্ত, তিন চার জন ছাত্র বরাবর ডাঃ ওয়াটসনের সঙ্গে, তাঁহার তত্ত্বাবধানে কাজ করিয়াছিলেন। ডাঃ ওয়াটসনের কয়েকজন ছাত্র পরবর্তীকালে রাসায়নিক গবেষণা করিয়া যশ ও খ্যাতি লাভ এবং জ্ঞানভাণ্ডারের ঐশ্বর্য বৃদ্ধি করিয়াছিলেন।