যোগে প্রচারিত হইবে এবং রয়টার উহা ভারতে প্রেরণ করিবেন; তাহা হইলে ঐ বক্তৃতা সমস্ত সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হইবে এবং উহা ভারতের সর্বত্র পঠিত হইবে। ভারত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি প্রধান অংশ। সুতরাং উচ্চতর বিজ্ঞানের প্রসার সম্বন্ধে একই নীতি সাম্রাজ্যের অন্যান্য অংশে ও ভারতে কেন অনুসৃত হইবে না, তাহা আমি বুঝিতে অক্ষম।
“আমি বিশেষভাবে একটি তথ্যের প্রতি সভার দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। এই ভারতীয় জাতি অতীতে গৌরবের উচ্চ শিখরে আরোহণ করিয়াছে। ম্যাক্সমূলার এক স্থলে বলিয়াছেন যে, হিন্দুরা যদি আর কিছু না করিয়া ইয়োরোপকে শধু দশমিক পদ্ধতি দান করিত—উহা আরবীয় নহে, আরবেরা কেবল মধ্যস্থরূপে ইয়োরোপে ঐ বিদ্যা প্রচার করিয়াছেন,—তাহা হইলেও, ভারতের নিকট ইয়োরোপের ঋণ অসীম হইত। হিন্দুদের অন্তর্নিহিত মানসিক শক্তি যে অসাধারণ অতীতের স্মৃতিমণ্ডিত এই প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকট তাহা অজ্ঞাত নহে। হিন্দু প্রতিভা সূযোগ ও উৎসাহ লাভ করিলে কি করিতে পারে, তাহার যথেষ্ট প্রমাণ আপনারা পাইয়াছেন। এই প্রসঙ্গে, পারাঞ্জপে, রামানুজ এবং জগদীশচন্দ্র বসুর নাম করিলেই যথেষ্ট হইবে। তাঁহারা সকলেই এই কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষালাভ করিয়াছিলেন।
“আমি মনে করি, দুইটি কারণে এখানে বক্তৃতা করিবার আমার অধিকার আছে। পূর্বেই বলিয়াছি, আমাদের সম্মানিত সভাপতি মহাশয়ের নেতৃত্বে আমি ইতিপূর্বে আর একবার বক্তৃতা করিয়াছি। দ্বিতীয়তঃ প্রায় অর্ধ শতাব্দী পূর্বে, উত্তরাঞ্চলের প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ে (এডিনবার্গে) আমি ছয় বৎসর ছাত্র রূপে শিক্ষালাভ করিয়াছিলাম। সভাপতি মহাশয় বর্তমানে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। সুতরাং রাসায়নিকের ভাষায় বলিতে পারি, আমি তাঁহার সঙ্গে দ্বিবিধ বন্ধনে আবদ্ধ।
“আমি আশাকরি ভারত গবর্ণমেণ্ট অথবা বাংলা গবর্ণমেণ্ট এখন বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান কলেজের সাহায্যার্থ অগ্রসর হইবেন। আমি হিসাব করিয়া দেখিয়াছি যে, বিজ্ঞান কলেজের জন্য আমরা গবর্ণমেণ্টের নিকট হইতে শতকরা দুই ভাগ মাত্র সাহায্য পাইয়াছি। অবশিষ্ট—শতকরা ৯৮ ভাগ সাহায্য আসিয়াছে আমাদের দেশবাসীর নিকট হইতে।”
ভারত গবর্ণমেণ্টের উপর সমস্ত দোষ চাপাইয়া দিয়া আমি যদি ক্ষান্ত হই, তবে অত্যন্ত অবিচার করা হইবে। আমার স্বদেশবাসীরও এ বিষয়ে যথেষ্ট দোষ। তাঁহাদের নিকট পুনঃ পুনঃ অর্থ সাহায্য চাহিয়াও বিশেষ কোন ফল হয় নাই। পালিত ও ঘোষ তাঁহাদের সমস্ত জীবনের সঞ্চিত অর্থ বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য দান করিয়া যে মহৎ দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করিয়াছেন, আর কেহ বড় একটা তাহার অনুসরণ করেন নাই। বড় বড় ব্যবসায়ী, বণিক প্রভৃতির সহানভূতি সাধারণের হিতার্থ আকৃষ্ট করা যায় নাই—বাংলাদেশের এই দুর্ভাগ্যের কথা আমি অন্যত্র আলোচনা করিয়াছি। কিন্তু বাংলার শিক্ষিত সমাজও আমাদের আবেদনে কর্ণপাত করেন নাই। শ্রেষ্ঠ আইনজীবিগণ, বিচার ও শাসন বিভাগের কর্মচারিগণ, একাউণ্টাণ্ট জেনারেল, সেক্রেটারিয়েটের বড় বড় কর্মচারী, মন্ত্রী, শাসন পরিষদের সদস্য, যাঁহারা নির্লজ্জ ভাবে বার্ষিক ৬৪ হাজার টাকা বেতন গ্রহণ করেন,—নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকট যাঁহারা বিশ্বের ঋণী—এ পর্যন্ত তাঁহারা কোন সাড়াই দেন নাই। তাঁহারা কেবল নিজেদের সোণার সিন্দুক বোঝাই করিয়াছেন মাত্র। বিলাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সব ছাত্র পর জীবনে কৃতিত্ব লাভ করেন, তাঁহারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য বৃত্তি, দান প্রভৃতির ব্যবস্থা করেন, এরূপ ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়।