পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

সময়ের সদ্ব্যবহার ও অপব্যবহার

 সম্প্রতি কয়েক বৎসর হইল, কেহ কেহ আমাকে প্রশ্ন করিতেছেন, আমি আমার প্রিয় বিজ্ঞান ও গবেষণাগার ত্যাগ করিয়াছি কিনা, কিংবা উভয়কেই উপেক্ষা করিতেছি কি না? লোকের পক্ষে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা অসঙ্গত নহে। ১৯২১ সাল হইতে খদ্দর প্রচার ও জাতীয় শিক্ষা বিস্তারে আমি প্রধান অংশ গ্রহণ করিয়াছি এবং কিয়ৎ পরিমাণে রাজনৈতিক আন্দোলনের সংশ্রবেও আসিয়াছি। আমি কয়েকটি জেলা সম্মেলনের সভাপতিত্ব করিয়াছি। তথাকথিত “অবনত সম্প্রদায়” কর্তৃক আহূত কয়েকটি সম্মেলনেও সভাপতির পদ গ্রহণ করিয়াছি। এতদ্ব্যতীত, ১৯২১ সালের খুলনা দুর্ভিক্ষ এবং ১৯২২ সালের উত্তরবঙ্গ বন্যা সম্পর্কে সেবাকার্যের নেতৃত্বও কয়েকবার আমাকে করিতে হইয়াছে। গত দশ বৎসরে আমি ভারতের এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়াছি এবং আমার ভ্রমণের পরিমাণ দুই লক্ষ মাইলের কম হইবে না। ১৯২০ সালে এবং ১৯২৬ সালে যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম বার বিলাত ভ্রমণও করিয়া আসিয়াছি।

 সম্প্রতি একদল যুবকের নিকট আমি সময়ের ব্যবহার ও অপব্যবহার সম্বন্ধে বক্তৃতা করি। উহাতে আমি কতকটা আমার নিজের জীবনযাত্রা প্রণালীরই যেন সমর্থন করি। বক্তৃতায় কবি কাউপারের সেই প্রসিদ্ধ কবিতা[] উদ্ধৃত করিয়া আমি বুঝাইয়াছিলাম, যদি কেহ নিজের নির্দিষ্ট সময় তালিকা অনুসারে কাজ করে, তবে কত বেশী কাজ করিতে পারে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, মানুষ যদি ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করে, তবে দশ গুণ বেশী কাজ করিতে পারে। ইংলণ্ড ও ইয়োরোপে কয়েকবার ভ্রমণকালে আমি যাহাতে ঠিক সকাল সাতটার মধ্যে প্রাতর্ভোজন শেষ করিতে পারি, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখিতাম। তাহার ফলে বাড়ী হইতে বাহির হইবার পূর্বে আমি দু একঘণ্টা অধ্যয়ন করিবার অবসর পাইতাম। পূর্বে রেলগাড়ীতে ভ্রমণ করিবার সময় ঝাঁকানির জন্য আমি পড়িতে পারিতাম না। কিন্তু সম্প্রতি এইভাবে ভ্রমণ করা আমার পক্ষে এমন অভ্যাস হইয়া গিয়াছে যে, আমি গাড়ীতে একঘণ্টাকাল অনায়াসে পড়িতে পারি। আমার ভ্রমণ তালিকা প্রস্তুত করিবার সময় আমি প্রথমেই বড় হরফে ছাপা কতকগুলি ভাল বই বাছিয়া লই। আমি যখন কলিকাতার বাহিরে মফঃস্বলে যাই, তখন স্বভাবতঃই বহু লোক আমার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করিতে আসেন এবং তাঁহাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করিতে হয়। কিন্তু দ্বিপ্রহর হইতে বেলা ৩টা পর্যন্ত, অর্থাৎ খুব গরমের সময়, কেহ বড় একটা আসে না এবং সেই সময়ে আমি ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া বই পড়ি। উহাই আমার পক্ষে বিশ্রামের কাজ করে। কার্লাইলের ন্যায় আমিও বলিতে পারি, অধ্যয়নই আমার প্রধান বিশ্রাম। কার্লাইল লণ্ডনে গিয়া এমন স্থানে বাড়ী লইবার জন্য উৎকণ্ঠিত হইয়াছিলেন—যেখানে কেহ তাঁহাকে বিরক্ত করিতে না পারে। তাঁহার মনোভাবের প্রতি আমার সহানভূতি আছে। কার্লাইল যে


  1. The lapse of time and rivers is the same:
    Both speed their journey with a restless stream;
    But time that should enrich the nobler mind
    Neglected, leaves a dreary waste behind.