পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৩৮
আত্মচরিত

এত বেশী অধ্যয়ন করিয়াছিলেন—বিভিন্ন ভাষায় এমন পাণ্ডিত্য লাভ করিয়াছিলেন, তাহার প্রধান কারণ, তিনি ‘মেনহিলের’ নির্জ্জন গৃহে বাস করিবার সুযোগ লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহার চরিতকারের ভাষায়, লণ্ডনে যাইবার পূর্বে, “ইংলণ্ড ও স্কটলণ্ডে তাঁহার সমবয়স্ক এমন কেহ ছিল না, যে তাঁহার মত এত বেশী পড়াশুনা করিয়াছে অথচ বহির্জগতের সঙ্গে যাহার এত কম পরিচয় ছিল। ইতিহাস, কাব্য, দর্শনশাস্ত্রে তিনি প্রগাঢ়রূপে অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। ফরাসী, জার্মান ও ইংরাজী সাহিত্য তথা সমগ্র আধুনিক সাহিত্যের সম্বন্ধে তাঁহার যেমন গভীর জ্ঞান ছিল, তাঁহার সমবয়স্ক আর কোন ব্যক্তিরই তেমন ছিল না।”

 আমি আমার অধ্যয়ন কার্যকে পবিত্র বলিয়া মনে করি। কিন্তু ইহার পবিত্রতা রক্ষা করা অনেক সময় কঠিন হইয়া পড়ে। যখন কেহ অধ্যয়ননিমগ্ন আছেন, অথবা কোন সমস্যা গভীরভাবে চিন্তা করিতেছেন—তখন তাঁহার কাজে ব্যাঘাত জন্মাইতে আমাদের দেশের শিক্ষিত লোকেরাও দ্বিধা করেন না। মেকলের প্রগাঢ় অধ্যয়নস্পৃহার কথাও এখানে উল্লেখ করা যাইতে পারে। “সাহিত্য আমার জীবন ও বিচারবুদ্ধিকে রক্ষা করিয়াছে। সকাল পাঁচটা হইতে নয়টা পর্যন্ত (তাঁহার কলিকাতা বাস কালে) এই সময়টা আমার নিজস্ব এখনও আমি ঐ সময়ে প্রাচীন সাহিত্য পাঠ করিয়া থাকি।” কিন্তু এইরূপে কঠোর সাধনা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমার ইচ্ছা থাকিলেও এরূপ করিবার শক্তি আমার নাই। আমার ভাল ঘুম হয় না, সুতরাং সকালবেলা একসঙ্গে সওয়া ঘণ্টার বেশী আমি পড়িতে পারি না।

 মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব আবিষ্কার করিবার সময়ে নিউটন প্রায় ভাবোন্মাদ অবস্থায় ছিলেন। যদি লোকে সেই সময়ে তাঁহাকে ক্রমাগত বিরক্ত করিত, তবে অবস্থা কিরূপ হইত, কল্পনা করাও কঠিন। কোলরিজ এ বিষয়ে তাঁহার তিক্ত অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। একসময়ে তিনি ভাবমুগ্ধ অবস্থায় “কুবলা খাঁ অথবা একটি স্বপ্নদৃশ্য” নামক প্রসিদ্ধ কবিতার দুই তিনশত ছত্র মনে মনে রচনা করেন। তন্দ্রা হইতে জাগিয়া তিনি কাগজে সেই ছত্রগুলি লিপিবদ্ধ করিতেছিলেন, এমন সময় অন্য কাজে তাঁহার ডাক পড়িল এবং সেজন্য তাঁহাকে একঘণ্টারও অধিক সময় ব্যয় করিতে হইল। ফিরিবার সময় লিখিতে বসিয়া তিনি দেখেন যে, স্বপ্নের কথা তাঁহার মাত্র অস্পষ্টভাবে মনে আছে। এমার্সন গভীর ক্ষোভের সঙ্গে বলিয়াছেন —“সময় সময় সমস্ত পৃথিবী যেন ষড়যন্ত্র করিয়া তোমাকে তুচ্ছ তুচ্ছ বিষয়ে বন্দী করিয়া রাখিতে চায়।......এই সব প্রবঞ্চিত এবং প্রুবঞ্চনাকারী লোকের মন যোগাইয়া চলিও না। তাহাদিগকে বল—হে পিতা, হে মাতা, হে পত্নী, হে ভ্রাতা, হে বন্ধু, আমি তোমাদের সঙ্গে এতদিন মিথ্যা মায়াময় জীবন যাপন করিয়াছি। এখন হইতে আমি কেবল সত্যকেই অনুসরণ করিব।”[]

 লোকে যেরূপ অবস্থার মধ্যে থাকে, তাহারই সঙ্গে সামঞ্জস্য করিয়া লইতে হয়, বৃথা উত্তেজিত বা বিরক্ত হইয়া লাভ নাই। বহুলোক আমার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করিতে আসেন। ইহাদের মধ্যে অধিকাংশই যুবক। তাঁহারা আমার নিকট নানা বিষয়ের সংবাদ ও পরামর্শ চান। কিরূপে জীবিকা সংগ্রহ করিবেন, সেজন্যও উপদেশ চাহেন। ইহার উপর ভারতের সমস্ত অঞ্চল হইতে আমার নিকট বহু চিঠিপত্র আসে এবং পত্রলেখকেরা অনেক সময়


  1. মুসোলিনী যখন লিখেন, তখন কেহ তাঁহাকে বিরক্ত করিবে, এ তিনি ইচ্ছা করেন না। ... তিনি যে ইহাতে কিরূপ ক্ষুদ্ধ হন, তাহা রসাটোর একটি বর্ণনায় বুঝা যায়। তাঁহার (মুসোলিনীর) লিখিবার টেবিলের উপর ২০ রাউণ্ডের একটি বড় রিভলভার এবং একখানি চকচকে ধারালো বড় ছুরি থাকে। কালির আধারের উপর একটি ছোট রিভলভার থাকে। * * “কেহই এখানে আসিতে পারিবে না, যদি কেহ আসে তাহাকে গুলি করিয়া মারিব।”