নাই। অনেক লোক বই পড়িয়া পড়িয়া নিজেদের স্বাতন্ত্র্য হারাইয়া ফেলেন। তাঁহারা দেখেন যে সব কথাই বলা হইয়াছে, নূতন কিছু বলিবার নাই। প্যাস্কাল, ডেকার্ট, রুসো প্রভৃতির মত ‘অজ্ঞ লোক’ যাঁহারা খুব কম বই-ই পড়িয়াছেন, কিন্তু চিন্তা করিয়াছেন বেশী, নূতন কথা বলিবার যাঁহাদের সাহস ছিল বেশী, তাঁহারাই জগতকে পরিচালিত করিয়াছেন।” (মর্লির স্মৃতিকথা)।
গোল্ডস্মিথের ‘ভাইকার অব ওয়েকফিল্ড’-এর প্রতি আমার আকর্ষণের কথা পূর্বেই বলিয়াছি। ইহার চরিত্রগুলি কি মানবিকতায় পূর্ণ! ঊনবিংশ শতাব্দীর দুইজন প্রসিদ্ধ লেখক এই বইয়ের ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছেন। স্কট বলেন,—“ভাইকার অব ওয়েকফিল্ড” আমার যৌবনে ও পরিণত বয়সে পড়ি, পুনঃ পুনঃ ইহার শরণ লই এবং যে লেখক মানব প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের এমন সহানুভূতিসম্পন্ন করিয়া তোলেন, তাঁহার স্মৃতির প্রতি স্বভাবতঃই শ্রদ্ধা হয়।” গ্যেটে বলেন,—“তরুণ বয়সে আমার মন যখন গঠিত হইয়া উঠিতেছিল, তখন এই বই আমার মনের উপর কি অসীম প্রভাব বিস্তার করিতেছিল, তাহা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ইঁহার মার্জিতরুচিপ্রসত শ্লেষ ও বিদ্রূপ, মানবচরিত্রের ত্রুটী ও দুর্বলতার প্রতি উদার সহানভূতি, সর্বপ্রকার বিপদের মধ্যে শান্তভাব, সমস্ত বৈচিত্র্য ও পরিবর্তনের মধ্যে চিত্তের সমতা এবং উহার আনুষঙ্গিক গুণাবলী হইতে আমি যথেষ্ট শিক্ষা পাইয়াছিলাম।”
অনেক পুস্তককীট আছেন, মেকলে তাঁহাদের বলেন—‘মস্তিষ্ক-বিলাসীর দল’। ইঁহারা একটির পর একটি করিয়া পুস্তক পাঠ শেষ করেন, কিন্তু গ্রন্থের আলোচ্য বিষয় সম্বন্ধে কখনও চিন্তা বা আলোচনা করেন না। ফলে এইসব গ্রন্থকীট শীঘ্রই তাঁহাদের চিন্তাশক্তি হারাইয়া ফেলেন। তাঁহাদের কেবল লক্ষ্য, কতকগুলি বই পড়িবেন, আর কোন বিষয়ে চিন্তা করিবার সময় তাঁহাদের নাই।
এইখানে আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলিব। ১৯২০ সালে লণ্ডনে থাকিবার সময়ে J. M. Keynes প্রণীত The Economic Consequence of the Peace বা ‘সন্ধির অর্থনৈতিক পরিণাম’ নামক সদ্যপ্রকাশিত গ্রন্থ পাঠ করি। সন্ধিসর্তের ফলে জার্মানির নিকট কঠোরভাবে ক্ষতিপূরণ আদায় করিবার যে ব্যবস্থা হইয়াছিল, তাহা হ্রাস না করিলে, কেবল মধ্য ইয়োরোপ নয়, সঙ্গে সঙ্গে ইংলণ্ড ও আমেরিকার যে অসীম আর্থিক দুর্গতি ঘটিবে, গ্রন্থকার ভবিষ্যৎদর্শী ঋষির দৃষ্টিতেই তাহা দেখিয়াছিলেন। পুস্তকের এই অংশের প্রুফ যখন আমি সংশোধন করিতেছি (এপ্রিল, ১৯৩২), আমি দেখিতেছি কেসের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলিয়াছে। পরে আমি পুনর্বার ঐ পুস্তক মনোযোগ সহকারে পড়িয়াছি।
কেবল সময় কাটাইবার জন্য নয়, জীবনের আনন্দ বৃদ্ধি করিবার জন্যও প্রত্যেকের রুচি অনুযায়ী একটা আনুষঙ্গিক কাজ বা ‘বাতিক’ (hobby) থাকা চাই। যাঁহারা অবসর বিনোদনের উপায় রূপে বিজ্ঞানচর্চা করিয়া জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করিয়াছেন, এমন কতকগুলি লোকের নাম করা যাইতে পারে, যথা—ল্যাভোয়াসিয়ার, প্রিষ্টলে, শীলে, এবং ক্যাভেন্ডিশ। ডায়োক্লিশিয়ান এবং ওয়াশিংটন কার্যময় জীবন হইতে অবসর লইয়া বৃদ্ধবয়সে পল্লিজীবনের নির্জনতায় কৃষিকার্য করিয়া সময় কাটাইতেন। গ্যারিবল্ডিও ঐরূপ করিতেন। অন্য অনেকে, মানব-হিতে, রুগ্ন ও দরিদ্রের দুঃখমোচনে, এবং অন্যান্য নানারূপ সমাজ সেবায় আনন্দ অনুভব করিয়াছেন। কেহ কেহ বা শিল্পকলা—যথা সঙ্গীত, চিত্রবিদ্যা প্রভৃতির চর্চায় সময় কাটাইয়াছেন। এ-বিষয়ে কোন বাঁধাধরা নিয়ম নাই, লোকের