পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪৪
আত্মচরিত

রুচির উপর ইহা নির্ভর করে। কথায় বলে—অলস মন, শয়তানের আড্ডা। যে সব কাজের কথা উল্লেখ করিলাম, তরল আমোদ প্রমোদ হইতে আত্মরক্ষা করিবার উহাই শ্রেষ্ঠ উপায়। ‘আত্মন্যেব চ সন্তুষ্টঃ’—অর্থাৎ নিজের মধ্যে নিজেই সর্বদা সন্তুষ্ট থাকা উচিত।

 অন্যের উপর যতই নির্ভর করা যায়, দুঃখ ততই বৃদ্ধি পায়। অধিকাংশ লোক দিনের কাজকর্ম শেষ হইলে, ক্লাবের জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠে, অথবা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডায় গল্প করিয়া সময় কাটায়। তাহারা সময়কে বধ করে বলিলেই ঠিক হয়। সর্বোপরি, সন্তোষ অভ্যাস করিতে হইবে। বাল্যকালে এডিসনের প্রবন্ধে পড়িয়াছিলাম—“আমোদ অপেক্ষা আনন্দই আমি চিরদিন বেশী পছন্দ করি।” আনন্দ জীবনের চক্রে যেন তৈলের ন্যায় কাজ করে। এমন সব লোক আছে, সামান্য কারণেই যাহাদের মেজাজ চটিয়া যায়। তুচ্ছ কারণে বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হইয়া উঠে। এই সমস্ত লোক সর্বদাই দুঃখ পায়। যাহারা অপ্রিয় ব্যাপার হাসিয়া উড়াইয়া দিতে পারে, তাহাদের সৌভাগ্য আমি কামনা করি, অন্যের মনোভাব সম্বন্ধে সব সময়ে ভাল দিকটাই দেখিতে হয়। ঈর্ষাকে পরিহার করিতে হইবে, ঈর্ষা লোকের জীবনীশক্তি নষ্ট করে। যাহাকে ঈর্ষা করা যায়, তাহার কোন ক্ষতি হয় না, কিন্তু যে ঈর্ষা করে, তাহার হৃদয় দগ্ধ হয়। হিংসা ও বিদ্বেষ মনের সন্তোষ নষ্ট করে। আর মনের সঙ্গে দেহের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। যে অন্যের প্রতি হিংসা করে, সে ভুলিয়া যায় যে তাহাতে তাহার নিজের মনের শান্তিও দূর হয়।

 “মিল বলেন, বৈষয়িক কার্যের অভ্যাস সাহিত্য-চর্চার উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে, ইহাতে শক্তি বৃদ্ধি পায়।” তাঁহার (মিলের) তরুণ বয়সের অভিজ্ঞতা এই যে, সমস্ত দিনের কাজের পর দুই ঘণ্টায় অনেক বেশী সাহিত্যসেবা করিতে পারিতেন; যখন তিনি প্রচুর অবসর লইয়া সাহিত্যচর্চা করিতে বসিতেন, তখন তেমন বেশী দূর অগ্রসর হইতে পারিতেন না। বৈষয়িক কার্যের সঙ্গে সাহিত্যচর্চার সমন্বয়ের প্রসিদ্ধ দৃষ্টান্ত বেজহটের জীবন। গিবন বলিতেন যে, শীতকালে লণ্ডনসমাজ ও পার্লামেণ্টের কর্মচঞ্চল জীবনের মধ্যে তিনি অধিক মানসিক শক্তি অনুভব করিতেন, রচনাকার্য তাঁহার পক্ষে বেশী সহজ হইত। গ্রোট প্রতিদিন তাঁহার ‘গ্রীসের ইতিহাস’ লিখিবার জন্য আধ ঘণ্টা সময় ব্যয় করিতেন, দুই খণ্ড গ্রন্থ বাহির হইবার পূর্বে ব্যাঙ্কের কাজে তাঁহাকে কঠোর পরিশ্রম করিতে হইত। আমাদের সমসাময়িক জনৈক লোকপ্রিয় ঔপন্যাসিক ডাকঘরের কর্মচারী ছিলেন। প্রত্যহ সকাল বেলা ৫টা-৬টার সময় তিনি ডাকঘরের কাজের মতই সময় নির্দিষ্ট করিয়া উপন্যাস লিখিতে বসিতেন।” (মর্লির স্মৃতি কথা, প্রথম খণ্ড, ১২৫ পূঃ।

 বৈষয়িক কার্যে কঠোর পরিশ্রম করিয়াও, কিরূপে সাহিত্য সেবা এবং বিদ্যানুশীলন করা যায়, তাহার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত, গ্রীসের ইতিহাসের প্রসিদ্ধ গ্রন্থকার জর্জ গ্রোটের জীবন। দশ বৎসর বয়সে তিনি ‘চার্টার হাউসে’ ভর্তি হন এবং ১৬ বৎসর বয়সে তাঁহার পিতা তাঁহাকে ব্যাঙ্কে শিক্ষানবীশ নিযুক্ত করেন। গ্রোটের বিদ্যাচর্চার প্রতি তাঁহার পিতার একটা অবজ্ঞার ভাবই ছিল। তিনি ব্যাঙ্কে ৩২ বৎসর কাজ করেন এবং ১৮৩০ সালে উহার প্রধান কর্মকর্তা হন। কিন্তু এই কার্যব্যস্ততার মধ্যেও তিনি অবসর সময়ে নিয়মিত ভাবে সাহিত্যসেবা ও রাজনীতি আলোচনা করিতেন। ১৮৪৩ সালে ব্যাঙ্ক হইতে অবসর গ্রহণের পর তিনি তাঁহার গ্রীসের ইতিহাস (১২ খণ্ড) শেষ করেন বটে; কিন্তু ১৮২২ সালেই তিনি ঐ গ্রন্থ লিখিবার সঙ্কল্প করেন এবং বরাবর উহার জন্য অধ্যয়ন ও মালমশলা সংগ্রহ কার্যে লিপ্ত ছিলেন। গ্রোট নূতন লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান প্রবর্তক। তিনি কয়েক বৎসর পার্লামেণ্টের সদস্যও ছিলেন।