পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৫০
আত্মচরিত

ইউরোপীর মহাযুদ্ধের সময় বহু প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক দেশের প্রতি কর্তব্যের আহ্বানে তাঁহাদের জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন। তাঁহাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ইংরাজ পদার্থ বিদ্যাবিৎ মোজলে অন্যতম। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসিদ্ধ পদার্থ বিদ্যাবিৎ মিলিক্যান তাঁহার সম্বন্ধে বলেন:—“২৬ বৎসর বয়স্ক এই তরুণ বৈজ্ঞানিক আণবিক জগত সম্বন্ধে যে গবেষণা করিয়াছেন, তাহা বিজ্ঞানের ইতিহাসে অপূর্ব, আমাদের চক্ষের সম্মুখে ইহা বহুতর রহস্যের নূতন দ্বার খুলিয়া দিয়াছে। ইউরোপীয় যুদ্ধে যদি এই তরণ বৈজ্ঞানিকের মৃত্যু ভিন্ন আর কোন অনর্থ না ঘটিত, তাহা হইলেও সভ্যতার ইতিহাসে ইহা একটি বীভৎস এবং অমার্জনীয় অপরাধ বলিয়া গণ্য হইত।”

 ১৯১৫ সালের ১০ই আগষ্ট প্রসিদ্ধ ফরাসী রসায়নবিৎ হেনরী ময়সানের একমাত্র পুত্র লুই যদ্ধক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করেন। যুদ্ধের পূর্বে তিনি কলেজে তাঁহার পিতার সহকারী ছিলেন।

 ভারতে বর্তমানে আমরা যেরূপ সঙ্কটময় সময়ে বাস করিতেছি, তাহাতে বিখ্যাত মনীষী হ্যারল্ড ল্যাস্কির নিম্নলিখিত সারগর্ভ মন্তব্য আমাদের প্রণিধান করা কর্তব্য:—

 “একথা নিশ্চিতরূপে বলা যাইতে পারে যে নিশ্চেষ্টতা শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কল্যাণ বৃদ্ধির অভাবে পর্যবসিত হয়। যাহারা বলে যে, কোন একটা অবিচারের প্রতিকার করিবার দায়িত্ব তাহাদের নহে, তাহারা শীঘ্রই অবিচার মাত্রই রোধ করিতে অক্ষম হইয়া উঠে। লোকের নিশ্চেষ্টতা ও জড়তার উপরেই অত্যাচারের আসন। অবিচারের বিরুদ্ধে কেহ কোন প্রতিবাদ করিবে না, বাধা দিবে না, এই ধারণার যখন সৃষ্টি হয়, তখনই স্বেচ্ছাচারীর প্রভুত্ব প্রবল হইয়া উঠে। ‘যে রাষ্ট্রের অধীনে কোন ব্যক্তিকে অন্যায়রূপে কারারুদ্ধ করা হয়, সেখানে প্রত্যেক খাঁটি ও সৎলোকের স্থানও কারাগারে’—থোরোর সেই প্রসিদ্ধ উক্তিটির মর্ম ইহাই, কেন না সে যদি অন্যায়ের ক্রমাগত প্রতিবাদ না করে, তবে মনে করিতে হইবে যে সে অন্যায় ও অবিচারকে প্রশ্রয় দিতেছে। তাহার নীরবতার ফলে সে-ই ‘জেলার’ বা কারাধ্যক্ষ হইয়া দাঁড়ায়। শাসকগণ তাহার উপর নির্ভর করে, মনে করে সে অতীতে যে নিশ্চেষ্টতার পরিচয় দিয়াছে, তাহাতেই প্রমাণ, তাহার বিবেক বুদ্ধি লোপ হইয়াছে। অত্যাচারী প্রভু, নিষ্ঠুর বিচারক এবং দুশ্চরিত্র রাজনীতিক—ইহাদের কাজে কেহ অতীতে বাধা দেয় নাই বলিয়াই, ইহারা নিজেদের ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে সাহসী হইয়াছে। তাহাদের অত্যাচার ও অবিচারকে একবার বাধা দেওয়া হোক, একজন সাহসের সহিত দণ্ডায়মান হোক, দেখিবে সহস্র লোক তাহার অনুসরণ করিতে প্রস্তুত। এবং যেখানে সহস্র লোক অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে প্রস্তুত, সেখানে অন্যায়কারীকে কোন কাজ করিবার পূর্বে পাঁচবার ভাবিতে হয়।”—(The Dangers of Obedience— pp. 19-20)

 ইংলণ্ড ও আমেরিকা প্রভৃতির ন্যায় উন্নত দেশে গণশক্তি জাগ্রত, সেখানে বহু কর্মী সাধারণের কাজে সম্পূর্ণরূপে আত্মনিয়োগ করিয়া থাকেন। সেখানেও লোকে এই অভিযোগ করে যে, বৈজ্ঞানিক ও সাহিত্যিক রাষ্ট্রনীতি হইতে দূরে থাকিয়া দেশের ক্ষতি করে। একজন চিন্তাশীল লেখক এই সম্পর্কে বলিয়াছেন:—

 “অনেক দিন হইতেই একটা কথা প্রচলিত আছে যে, বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিকের পক্ষে জনারণ্য হইতে দূরে নির্জনে বাস করা শ্রেয়ঃ। কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। বর্তমান যুগের জনসাধারণ চিন্তা ও ভাবে সাড়া দিতে জানে, তবে তাহারা নিজেদের সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতার মধ্যে সেগুলি বুঝিতে চায়। দৈনন্দিন কার্য-প্রবাহের মধ্যে উহাকে দেখিতে চায়। চিন্তা ও ভাবের আদর্শ যে জনসাধারণের বুদ্ধির স্তরে নামাইতে হইবে তাহা নহে,