পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৫২
আত্মচরিত

হলের দক্ষিণ দিকের সিঁড়ির উপরে এবং রাস্তাতেও বিপুল জনসমাগম হইয়াছিল। লোকে যাহাতে তাঁহার বক্তৃতা শুনিতে পারে, এই জন্য শ্রীযুক্ত চিত্তরঞ্জন দাশ সম্মুখের সিঁড়ির উপরে দাঁড়াইয়াছিলেন। আমি জনতার পশ্চাতে ছিলাম। এই সময়ে কেহ কেহ আমাকে দেখিতে পাইয়া সম্মুখের দিকে ঠেলিয়া দিল এবং চিত্তরঞ্জনের পার্শ্বেই আমি স্থান গ্রহণ করিলাম। আমি যাহাতে কিছু বলি, সেজন্য সকলেরই আগ্রহ ছিল। তাহার পর কি হইল, একখানি স্থানীয় দৈনিক পত্রে বর্ণিত হইয়াছে:—

 “মিঃ সি, আর, দাশ ডাঃ স্যার পি, সি, রায়কে আলোচ্য প্রস্তাব সম্বন্ধে বক্তৃতা করিবার জন্য আহ্বান করিলেন। ডাঃ রায় বক্তৃতা করিবার জন্য উঠিলেন। সেই সময়ে এমন একটি দৃশ্যের সৃষ্টি হইল, যাহা ভুলিতে পারা যায় না। কয়েক মিনিট পর্যন্ত ডাঃ রায় কোন কথা বলিতে পারিলেন না। কেন না তাঁহাকে অভিনন্দন করিয়া চারিদিকে ঘন ঘন আনন্দোচ্ছাস ও ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি হইতে লাগিল। ডাক্তার রায় আরম্ভে বলিলেন যে তাঁহাকে যে সভায় বক্তৃতা করিতে হইবে, ইহা তিনি পূর্বে কল্পনা করিতে পারেন নাই। তিনি মাত্র দর্শক হিসাবে আসিয়াছিলেন। বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারেই তাঁহার কাজ। কিন্তু এমন সময় আসে, যখন বৈজ্ঞানিককেও—তাঁহার অবশিষ্ট কথাগুলি শ্রোতৃবর্গের আনন্দধ্বনির মধ্যে বিলুপ্ত হইয়া গেল। ডাঃ রায় পুনরায় বলিলেন—‘এমন সময় আসে যখন বৈজ্ঞানিককেও গবেষণা ছাড়িয়া দেশের আহ্বানে সাড়া দিতে হয়।’ আমাদের জাতীয় জীবনের উপর এমন বিপদ ঘনাইয়া আসিয়াছে যে ডাঃ পি, সি, রায় তাঁহার গবেষণাগার ছাড়িয়া এই ঘোর অনিষ্টকর আইনের প্রতিবাদ করিবার জন্য সভায় যোগ দিয়াছিলেন।” (অমৃতবাজার পত্রিকা, ফেব্রুয়ারী, ১৯১৯)।

 পূর্ব পৃষ্ঠায় বলা হইয়াছে যে ভারত ইউরোপীয় যুদ্ধের সময়ে ব্রিটেনকে বিশেষ ভাবে সাহায্য করিয়াছিল। নিম্নে ঐ সম্বন্ধে একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হইল।

 সহকারী ভারতসচিব লর্ড ইসলিংটন ‘ইণ্ডিয়া ডে’ বা ‘ভারত দিবস’ (৫ই অক্টোবর, ১৯১৮) উপলক্ষে একটি বিবৃতি পত্র প্রস্তুত করেন। উহাতে, ইউরোপীয় যুদ্ধে ভারতের দান তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা হয়। (ক) সৈন্য, (খ) যন্ত্রের উপকরণ, (গ) অর্থ; তন্মধ্যে প্রধান বিষয়গুলি উল্লেখ করা হইতেছে।

 (ক) সৈন্য—ভারত হইতে যে সব ভারতীয় ও ব্রিটিশ সৈন্য ৪ঠা আগষ্ট ১৯১৪ হইতে ৩১শে জুন ১৯১৮ পর্যন্ত প্রেরণ করা হইয়াছিল, তাহাদের সংখ্যা ১,১১৫,১৮৯।

 (খ) যুদ্ধের উপকরণ—ইহা বলিলে অত্যুক্তি হইবে না যে, যদি ভারতের প্রদত্ত মালমশলা উপকরণ প্রভৃতি ব্রিটেন না পাইত, তবে বিপদ আরও শতগুণে বৃদ্ধি পাইত এবং এরূপ ভাবে যুদ্ধ চালানো অসম্ভব হইত। মিশর, মেসপটেমিয়া এবং অন্যান্য স্থানের ভারতীয় সৈন্যের রসদ প্রভৃতি যোগাইবার জন্য তখন ব্রিটেনকে যুদ্ধের মালমশলা সরবরাহ করার জন্য ভারতে বিশেষভাবে একটি মিউনিশান বোর্ড স্থাপন করতে হইয়াছিল।

 (গ) অর্থ—১৯১৭ সালের জানুয়ারী মাসে, ভারত গবর্ণমেণ্ট যুদ্ধের ব্যয় স্বরূপ ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্টকে ১০ কোটী পাউণ্ড সাহায্য করেন। ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্ট তাহা সকৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করেন।

 ভারত গবর্ণমেণ্ট যুদ্ধের সময়ে সামরিক ব্যয় করিয়াছিলেন, তাহাতেই ভারতের আর্থিক দায়িত্ব শোধ হইয়া যায় নাই, বন্ধের জন্য নানা প্রকারে তাহার আর্থিক দায়িত্বভার বাড়িয়াছিল। বস্তুতঃ ভারত আর্থিক ব্যাপারে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রধান স্তম্ভস্বরূপ।

 বাংলার অসহযোগ আন্দোলনের প্রাণস্বরূপ চিত্তরঞ্জন দাশের কারাদণ্ডের সময়, আমি