পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
১৫৫

 বন্ধুবর্গের অনুরোধে দুর্গতদের সেবাকার্যের ব্যবস্থা এবং দেশবাসীর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিবার দায়িত্ব আমি গ্রহণ করিলাম। দেশবাসী সর্বান্তঃকরণে সাড়া দিল—যদিও গবর্ণমেণ্ট সরকারীভাবে খুলনার এই দুর্ভিক্ষকে স্বীকার করেন নাই। শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ সেন, জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ, কুঞ্জলাল ঘোষ, প্রভৃতি খুলনার জননায়কগণ আমাকে এই কার্যে বিশেষভাবে সহায়তা করেন, বরিশাল ও ফরিদপুর জেলা হইতে বহু স্বেচ্ছাসেবক আসিয়াও আমার কাজে বিশেষভাবে সাহায্য করেন।

 ১৯২২ সালের উত্তরবঙ্গ বন্যা সম্বন্ধে বলা যাইতে পারে যে, যদি গ্রামবাসীর প্রার্থনা গ্রাহ্য করা হইত, তাহা হইলে এই বন্যা নিবারিত হইতে পারিত, অন্ততঃপক্ষে ইহার প্রকোপ খুবই হ্রাস পাইত। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ভারতে এই সমস্ত আবেদন নিবেদন সরকারী কর্মচারীরা গ্রাহ্যও করেন না। যে কোন নিরপেক্ষ পাঠকই বুঝিতে পারিবেন যে গবর্ণমেণ্ট এই বন্যার জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী। বন্যা হইবার এক বৎসর পূর্বে গ্রামবাসীরা রেলওয়ে বাঁধ সম্পর্কে গবর্ণমেণ্টের নিকট দরখাস্ত করিয়াছিল। দরখাস্তকারিগণ অজ্ঞ গ্রামবাসী, কিন্তু একথা তাহারা বেশ বুঝিতে পারিয়াছিল যে, যদি রেলওয়ে বাঁধের সঙ্কীর্ণ ‘কালভার্ট’গুলির পরিবর্তে চওড়া সেতু করিবার ব্যবস্থা না হয়, তবে তাহাদিগকে সর্বদাই বন্যার বিপত্তি সহ্য করিতে হইবে। কিন্তু কার্যতঃ ঠিক ইহাই ঘটিয়াছিল। আসল কথা এই যে, বিদেশী অংশীদারদের স্বার্থের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া রেলওয়ে রাস্তা ও বাঁধগুলি তৈরী করা হয়। খরচা যত কম হইবে, অংশীদারদের লাভের অঙ্কও তত বেশী হইবে। এই কারণে রেলপথ নির্মাণ করিবার সময় বহু স্বাভাবিক জলনিকাশের পথ মাটী দিয়া বন্ধ করিয়া ফেলা হয়, অথবা তাহাদের পরিসর এত কম করা হয় যাহাতে সঙ্কীর্ণ ‘কালভার্ট’ দ্বারাই কাজ চলিতে পারে।[] আনন্দবাজার পত্রিকা ১৯২২ সালের ২১শে নবেম্বর তারিখে রেলওয়ে বাঁধই যে দেশের সর্বনাশের কারণ এই প্রসঙ্গে সম্পাদকীয় মন্তব্যে লিখিয়াছিলেন:—

 “রেলওয়ে লাইনই যে উত্তরবঙ্গের লোকদের অশেষ দুঃখ-দুর্দশার কারণ এ বিষয়ে আমরা কয়েকটি প্রবন্ধ ইতিপূর্বে লিখিয়াছি। আদমদীঘি এবং নসরতপুর অঞ্চলের (সান্তাহারের উত্তরে দুইটি রেলওয়ে ষ্টেশন) গ্রামবাসীরা, বগুড়ার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মারফৎ রেলওয়ে এজেণ্টের নিকট দরখাস্ত করে যে, পূর্বোক্ত দুইটি ষ্টেশনের মধ্যে রেলওয়ে লাইনে সঙ্কীর্ণ কালভার্টের পরিবর্তে চওড়া সেতু করা হোক, তাহা হইলে প্রবল বর্ষার পর উচ্চ ভূমি হইতে যে জলপ্রবাহ আসে, তাহা বাহির হইবার পথ পাইবে। ইহার উত্তরে রেলওয়ে এজেণ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নিম্নলিখিত পত্র লিখেন:—

নং ১৩৫৬—ভি, ডবলিউ

ই. বি. রেলওয়ের এজেণ্ট লেঃ কর্ণেল এইচ. এ. ক্যামেরন সি. আই. ই

বগুড়ার ম্যাজিষ্ট্রেটের বরাবর

কলিকাতা, ২৮শে অক্টোবর, ১৯২১
মহাশয়,

 আপনার ১৯২১ সালের ২৫শে এপ্রিল তারিখের পত্র পাইলাম। উহার সঙ্গে উমিরুদ্দীন জোদ্দার এবং আদমদীঘি ও তন্নিকটবর্তী গ্রামসমূহের অধিবাসিগণের যে


  1. বন্যার অব্যবহিত পরেই রাণীনগর স্টেশন হইতে নসরতপুর স্টেশন পর্যন্ত রেলওয়ে লাইনটি আমি দেখি এবং তাহার ফলে আমার এই অভিজ্ঞতা হয়।