পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৫৮
আত্মচরিত

রাজসাহীর বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলের আয়তন প্রায় তিনগুণ বেশী এবং সেখানে গৃহ ও সম্পত্তি ধ্বংস বাবদ ক্ষতির পরিমাণও অনেক বেশী। সরকারী স্বাস্থ্যবিভাগের সহকারী ডিরেক্টরের হিসাবকে ভিত্তিস্বরূপ ধরিলে পাবনা ও রাজসাহী জেলায় মোট ক্ষতির পরিমাণ ৫ কোটী টাকার কম হইবে না এবং সমগ্র বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলের ক্ষতির পরিমাণ ৬ কোটী টাকার ন্যূন হইবে না।

 বিজ্ঞান কলেজের প্রশস্ত গৃহে বন্যা সাহায্য সমিতির অফিস করা হইল এবং অপূর্ব উৎসাহের চাঞ্চল্যে ঐ বিদ্যামন্দিরের নীরবতা যেন ভঙ্গ হইল। দলে দলে নরনারী ঐ স্থানে যাতায়াত করিতে লাগিল। প্রায় সত্তর জন স্বেচ্ছাসেবক—তাহার মধ্যে কলিকাতার কলেজ সমূহ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকও ছিলেন—প্রত্যহ সকাল হইতে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত অনবরত কার্য করিতেন। সাধারণ কার্যালয়, কোষাগার, দ্রব্যভাণ্ডার, টাকাকড়ি জিনিষপত্র পাঠাইবার আফিস, এবং ঐ সমস্ত গ্রহণ করিবার আফিস এক একটি ঘরে। এই সমস্ত বিভিন্ন বিভাগের জন্য পৃথক পৃথক স্থান নির্দিষ্ট হইল। কলিকাতা আফিসের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল—প্রচার বিভাগ। জনসাধারণকে ঐ বিভাগ হইতে সঠিক সংবাদ সরবরাহ করা হইত। ভারতের সর্বত্র—এমন কি ইংলণ্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকাতেও সাহায্যের জন্য আবেদন করা হইল। এই বিশাল প্রতিষ্ঠানের কার্য ঠিক ঘড়ির কাঁটার মত নিয়মিত ভাবে চলিত। প্রতিষ্ঠানটি নানা শ্রেণীর লোক লইয়া গঠিত হইয়াছিল বটে, কিন্তু সকল কর্মীর প্রাণেই বন্যাপীড়িতদের জন্য সমবেদনা ও সেবার আগ্রহ ছিল—কাজেই সকলে ঐক্যবদ্ধ হইয়া কাজ করিতে পারিত।

 বেঙ্গল রিলিফ কমিটির সাফল্যের কারণ এই যে প্রথম হইতেই সমবায় এবং সহযোগিতার নীতি অনুসারে ইহার কার্য পরিচালিত হইয়াছিল। বন্যার ভীষণ দুঃসংবাদ প্রচারিত হওয়া মাত্র দেশের চারিদিকে অসংখ্য সাহায্য সমিতি গড়িয়া উঠিয়াছিল। বেঙ্গল রিলিফ কমিটি এই গুলির কার্যকে ঐক্যবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত না করিলে নানা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হইত এবং বহু শক্তির অপব্যয় হইত। বেঙ্গল রিলিফ কমিটি পূর্ব হইতেই অবস্থা বুঝিয়া, কংগ্রেস কমিটি, বেঙ্গল কেমিক্যাল এবং ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস, বেঙ্গল সোশ্যাল সার্ভিস লীগ, বঙ্গীয় যুবকসঙ্ঘ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে, কার্য নির্বাহক সমিতিতে তাঁহাদের প্রতিনিধি পাঠাইবার জন্য অনুরোধ করিয়াছিলেন; উদ্দেশ্য, যাহাতে পরস্পর পরামর্শ ও আলোচনা করিয়া কার্যের শৃঙ্খলা বিধান করা যাইতে পারে। এই আহ্বানে সকলেই সাড়া দিলেন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হস্তে বিভিন্ন অঞ্চলের ভার অর্পিত হইল। এইরূপে এমন একটি কার্যসঙ্ঘ গড়িয়া উঠিয়াছিল যাহার মধ্যে প্রত্যেক শাখা সঙ্ঘের স্বাতন্ত্র্য ও কার্যশক্তি অব্যাহত ছিল—অথচ সকলে মিলিয়া একটা বিরাট কার্য পরিচালনা সম্ভবপর হইয়াছিল।

 শ্রীমান সুভাষচন্দ্র বসুর হৃদয় আর্তের দুঃখে স্বভাবতঃই বিগলিত হয়। তিনিই স্বেচ্ছায় প্রথমে বন্যাবিধ্বস্ত স্থানে গিয়া অবস্থা স্বচক্ষে পরিদর্শন করেন। ডাঃ জে, এম. দাসগুপ্তও বহু স্বার্থত্যাগ করিয়া, বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলে কিছুকাল থাকিয়া সেবাসমিতি গঠন করেন। বগুড়ার নিঃস্বার্থ কর্মী শ্রীযুক্ত যতীন্দ্রনাথ রায়, নৌকার অভাবে কেরোসিন টিনের তৈরী নৌকায় চড়িয়া কয়েক মণ চাউল লইয়া বন্যাপীড়িতদের সাহায্যার্থ অগ্রসর হন। বেঙ্গল কেমিক্যালের সহপারিনটেণ্ডেণ্ট শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র দাশগুপ্তও তাঁহার কারখানা হইতে বহু স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ করিয়া বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলে গমন করেন।

 প্রায় দুইমাস পরে শ্রীযুত সুভাষচন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আহ্বানে রাজনৈতিক কার্যে যোগ দিবার জন্য গেলে, ডাঃ ইন্দ্রনারায়ণ সেনগুপ্ত, তাঁহার কার্যভার গ্রহণ