স্যার পি, সি, রায়
“এইরূপ অবস্থায় একজন রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপক, স্যার পি, সি, রায় কার্যক্ষেত্রে অগ্রসর হইলেন এবং গবর্ণমেণ্ট যে দায়িত্ব পালনে ঔদাসীন্য প্রদর্শন করিয়াছেন, দেশবাসীকে তাহাই করিবার জন্য আহ্বান করিলেন। তাঁহার আহ্বানে সকলে সোৎসাহে সাড়া দিল। বাংলার জনসাধারণ একমাসের মধ্যেই তিন লক্ষ টাকা সাহায্য করিল। ধনী স্ত্রীলোকেরা তাঁহাদের রেশমের শাড়ী এবং গহনা দান করিলেন, গরীবেরা তাঁহাদের উদ্বৃত্ত পরিধেয় বস্ত্রাদি দান করিলেন। শত শত যুবক বন্যাপীড়িত স্থানে সেবাকার্যের জন্য অগ্রসর হইল। কাজটি কঠোর পরিশ্রমসাধ্য এবং ম্যালেরিয়াপূর্ণ স্থানে স্বাস্থ্যভঙ্গের আশঙ্কাও আছে।
“গবর্ণমেণ্টের প্রতি লোকের অসন্তোষ বৃদ্ধির আরও কারণ এই যে, তাহাদের বিশ্বাস রেললাইন নির্মাণের ত্রুটীই এই বন্যার কারণ, বন্যার জল নিকাশের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা রেলপথ নির্মাণের সময় করা হয় নাই। এই অভিমত সমর্থনের পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ আছে। কিন্তু বন্যার প্রায় দেড় মাস পরে গবর্ণমেণ্ট এ সম্বন্ধে তদন্ত করিবার প্রতিশ্রুতি দিলেন।
শক্তিশালী ব্যক্তি
“স্যার পি, সি, রায়ের আহ্বানে সাড়া দিবার একটা কারণ,—বৈদেশিক গবর্ণমেণ্টকে প্রতিযোগিতায় পরাজিত করিবার স্বাভাবিক ইচ্ছা, আর একটা কারণ দুর্গতদের সেবা করিবার প্রবৃত্তি। কিন্তু স্যার পি, সি, রায়ের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও তাঁহার প্রভাবই ইহার প্রধান কারণ। স্যার পি, সি, রায় বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক। তাঁহাকে গোঁড়া অসহযোগী বলা যাইতে পারে না, কিন্তু তিনি একজন প্রবল জাতীয়তাবাদী এবং গবর্ণমেণ্টের কার্যের তীব্র সমালোচক। শিক্ষক এবং সংগঠন কর্তা হিসাবেও তাঁহার ক্ষমতা অসাধারণ। একজন ইউরোপীয়কে আমি বলিতে শুনিয়াছি—‘মিঃ গান্ধী যদি আর দুইজন স্যার পি, সি, রায় তৈরী করিতে পারিতেন, তবে এক বৎসরের মধ্যেই তিনি স্বরাজ লাভে সক্ষম হইতেন।’ একজন বাঙালী ছাত্র আমাকে বলিয়াছিলেন, ‘যদি কোন সরকারী কর্মচারী অথবা কোন অসহযোগী রাজনীতিক সাধারণের কাছে সাহায্য চাহিতেন, তবে লোকে এক পয়সাও দিত কিনা সন্দেহ। কিন্তু যখন স্যার পি, সি, রায় সাহায্য চাহিলেন, তখন লোকে জানে যে অর্থের সদ্ব্যয় হইবে এবং এক পয়সাও অপব্যয় হইবে না।’ কলিকাতায় বিজ্ঞান কলেজে স্যার পি, সি, রায়কে দেখিবার সৌভাগ্য আমার হইয়াছে এবং আমি বুঝিতে পারিয়াছি কেন তাঁহার স্বদেশবাসিগণের তাঁহার উপর এমন প্রগাঢ় আস্থা। একদিন দেখিলাম, বন্যাপীড়িতদের জন্য দেশবাসীর প্রদত্ত যে সব নূতন ও পুরাতন বস্ত্র স্তুপীকৃত হইয়াছে, সেইগুলি তিনি সানন্দে পর্যবেক্ষণ করিতেছেন। স্বেচ্ছাসেবকরা তাঁহার সম্মুখে সেইগুলি গুছাইতেছেন এবং বিভিন্ন সাহায্যকেন্দ্রে পাঠাইবার ব্যবস্থা করিতেছেন। পরদিন দেখিলাম, তিনি দুইজন তরুণ ছাত্রকে রাসায়নিক পরীক্ষায় সাহায্য করিতেছেন,—আমার বোধ হইল শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে যথেষ্ট প্রীতির সম্বন্ধ বর্তমান। গবর্ণমেণ্টের কথা যখন তিনি বলিলেন, তখন আমার মনে হইল যে, তাঁহার সমালোচনার বিষয়ীভূত হওয়া অপেক্ষা তাঁহার অধীনে কাজ করা বহুগুণে শ্রেয়ঃ। তিনি এমন আবেগময় ও উৎসাহী প্রকৃতির লোক যে, তাঁহার পক্ষে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ সমালোচক হওয়া কঠিন। কিন্তু তাঁহার সমালোচনায় যদি কাহারও মনে আঘাত লাগে, তবে তিনি এই ভাবিয়া তৃপ্তিলাভ করিতে পারেন যে, সাধারণ সমালোচকদের ন্যায় তিনি দায়িত্ব এড়াইবেন না, বরং সুযোগ পাইলে, নিজে সেই কর্তব্যভার গ্রহণ করিবেন এবং শেষ পর্যন্ত তাহা সম্পন্ন করিবেন। বন্যার প্রায় দেড়মাস পরে আমি