পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
১৬১

বিধ্বস্ত গ্রামগুলি দেখিতে গেলাম। বন্যার জল তখন নামিয়া গিয়াছে, কিন্তু ক্ষতির চিহ্ন সুস্পষ্ট বর্তমান। বিভিন্ন সেবা-সমিতিগুলি অক্লান্তভাবে কাজ করিতেছে। স্যার পি, সি, রায়ের ‘বেঙ্গল রিলিফ সমিতি’ তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা বৃহৎ প্রতিষ্ঠান এবং ইঁহারা খুব শৃঙ্খলার সহিত কাজও করিতেছিলেন। ইহা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নহে, কিন্তু ইহার হিন্দুস্থানী কর্মীদের মধ্যে দেখিলাম সকলেই অসহযোগী।

সাহায্য সমিতির কর্মিগণ

 “সাহায্য সমিতির কর্ম পরিচালনার ভার ন্যস্ত হইয়াছিল, একজন বাঙালী যুবকের উপর (শ্রীযুত সুভাষচন্দ্র বসু)। ইনি প্রায় দুই বৎসর পূর্বে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, কিন্তু পরে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়া সিভিল সার্ভিস ত্যাগ করেন। সেই অবধি ইনি রাজনৈতিক আন্দোলনে সংসৃষ্ট আছেন। তাঁহার অধীনে প্রায় দুই শত স্বেচ্ছাসেবক সাহায্যকেন্দ্রে কাজ করিতেছেন, ইঁহাদের বয়স ১৭ হইতে ২৫ বৎসরের মধ্যে। সওদাগর আফিসের কয়েকজন কেরাণী তাঁহাদের প্রভুদের অনুমতি লইয়া এই সাহায্যকেন্দ্রে কর্মিরূপে যোগদান করিয়াছেন। চিকিৎসা বিভাগে কাজ করিবার জন্য কয়েকজন ডাক্তারও ছিলেন। কিন্তু অধিকাংশ স্বেচ্ছাসেবকই কংগ্রেস কর্মী। তাঁহাদের মধ্যে অনেকে গান্ধিজীর আহ্বানে সরকারী স্কুল কলেজ ত্যাগ করিয়াছিলেন। ইঁহাদের মধ্যে আমি একজন ‘অসহযোগী’ ভারতীয় খৃষ্টান যুবককে দেখিলাম,—আর একজন হিন্দু যুবককে দেখিলাম, তিনি যুদ্ধের পূর্বে বিপ্লব আন্দোলনে জড়িত সন্দেহে অন্তরীণ হইয়াছিলেন।

 “মোটের উপর প্রতিষ্ঠানটি ভাল বলিয়া বোধ হইল, স্বেচ্ছাসেবকদের কর্মের আদর্শও খুব উচ্চ বলিয়া মনে হইল। তাঁহারা বিধ্বস্ত গ্রামগুলিতে স্বয়ং যান, নিজেরা সমস্ত অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন এবং গ্রামবাসীদের নিকট হইতে তাহাদের দুঃখদুর্দশা ও ক্ষতির পরিমাণ সম্বন্ধে তদন্ত করেন। তারপর, তাঁহারা গ্রামবাসীদের যাহা প্রয়োজন তাহা নিজেরা গিয়া দিয়া আসেন অথবা গ্রামবাসীদের নিকটবর্তী সাহায্যকেন্দ্র হইতে তাহাদের প্রয়োজনীয় জিনিষ সংগ্রহ করিবার জন্য অনুমতিপত্র দেন। এইভাবে গ্রামবাসীদিগকে যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্য, ঔষধ ও বস্ত্রাদি বিতরণ করা হইয়াছে এবং গৃহনির্মাণের উপকরণ ও গোমহিষাদি পশুর খাদ্য বিতরণ কার্য আরম্ভ হইয়াছে। অন্যান্য সাহায্য সমিতিও কাজ করিতেছে এবং গবর্ণমেণ্টও অনেক কাজ করিয়াছেন ও করিতেছেন। কিন্তু আমি অনুসন্ধানের ফলে বুঝিলাম যে গবর্ণমেণ্টের বিরদ্ধে লোকের অভিযোগের কারণ আছে। তাহারা স্পষ্টই বলিল যে, এই সমস্ত ব্যাপারে গবর্ণমেণ্টের যথেষ্ট মর্যাদা হ্রাস হইয়াছে এবং অসহযোগীদের মর্যাদা বাড়িয়াছে। স্যার পি, সি, রায়ের স্বেচ্ছাসেবকদের উৎকৃষ্ট কার্যই ইহার প্রধান কারণ।

 “আমি সকল রকমের লোকের সঙ্গেই দেখা করিয়াছি এবং এ বিষয়ে কথাবার্তা বলিয়াছি। নিম্নপদস্থ সরকারী কর্মচারী, লোকাল বোর্ডের কর্মচারী, উকীল, জমিদার, রেল কর্মচারী, অসহযোগী স্বেচ্ছাসেবক এবং গ্রামবাসী সকলেই নিম্নলিখিতরূপে অভিমত প্রকাশ করিয়াছে। ছয় বৎসর পূর্বে ছোট রেল লাইনকে বড় লাইনে পরিণত করা হয়। ইহার ফলে জল নিকাশের পথ স্থানে স্থানে প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ সঙ্কুচিত হয়। ইহারই পরিণাম স্বরূপ, ১৯১৮ সালে প্রবল বন্যা হয়, ১৯২০ সালে আর একবার সামান্য আকারে একটা বন্যা হয় এবং তাহার পর বর্তমান বিপত্তি। স্থানীয় সরকারী কর্মচারিগণ পুনঃ পুনঃ সতর্ক করিয়া দিলেও, গবর্ণমেণ্ট তাহাতে কর্ণপাত করেন নাই। এখন গবর্ণমেণ্টের রেলওয়ে বিশেষজ্ঞগণ, রেলওয়ে বাঁধই যে বন্যার জন্য দায়ী এবং তাহার জন্য বিষম ক্ষতি