যাইতে পারে। তাহাদের কুঁড়ে ঘর ও মাটীর দেওয়াল বন্যার প্রথম আঘাতেই ভাঙিয়া পড়িয়াছিল। তাহাদের অনেকে গাছের উপর আশ্রয় লইয়াছিল এবং অনাহারে দুই তিন দিন কাটাইবার পর কর্মীরা নৌকা লইয়া গিয়া তাহাদের নামাইয়া আনিয়াছিল। আমি স্থানীয় একজন ক্ষুদ্র জমিদারের কথা শুনিয়াছি। তিনি নিজের নৌকা লইয়া উদ্ধার কার্য করিতেছিলেন। বন্যার দ্বিতীয় দিনে তিনি দেখেন, একটি ঘর তখনও টিকিয়া আছে। আর তাহার মধ্যে দুইটি মুরগী, একটি শিয়াল, একটি শশক, দুইজন মানুষ এবং কতকগুলি সাপ আশ্রয় লইয়াছে।
“গবর্ণমেণ্টের জনৈক সদস্য সেদিন বলিয়াছেন যে, গবর্ণমেণ্ট দাতব্য প্রতিষ্ঠান নহে। তিনি যদি বন্যাবিধ্বস্ত স্থানগুলি দেখিতেন এবং গ্রামবাসীদের অসীম দুর্দশা প্রত্যক্ষ করিতেন, তবে তিনি এই সময়ে এরূপ কথা বলিতে ইতস্ততঃ করিতেন।
গবর্ণমেণ্টের কোথায় কর্তব্যচ্যুতি হইয়াছে
“প্রকৃত কথা এই যে, যখন গবর্ণমেণ্টের উদার ও মুক্তহস্ত হওয়া উচিত ছিল তখনই তাঁহারা অতি সাবধানতা অবলম্বন করিয়াছিলেন। গ্রামবাসীদের জীবনোপায় নষ্ট হইয়া গিয়াছিল, তাহাদের মূলধন সামান্য যাহা কিছু ছিল, ধ্বংস হইয়ছিল এবং ভয়ে তাহারা বুদ্ধিহারা হইয়া পড়িয়াছিল। এই সময়ে এমন লোকের প্রয়োজন ছিল, যিনি তাঁহাদের প্রাণে সাহস সঞ্চার এবং তাহাদের সঙ্গে সহানভূতি প্রকাশ করিতে পারেন এবং যথাসাধ্য তাহাদের বিপদে সাহায্য করিয়া তাহাদিগকে ধ্বংসের মুখ হইতে বাঁচাইতে পারেন। স্থানীয় সরকারী কর্মচারীরা তাঁহাদের সাধ্যানুসারে এই কাজ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু গবর্ণমেণ্ট তাঁহাদের প্রয়োজনানুরূপ অর্থ দেন নাই, গ্রামবাসীকে বিশেষ কোন ভরসাও তাঁহারা দিতে পারেন নাই। সুতরাং ‘বেঙ্গল রিলিফ কমিটির’ উপরেই এই কাজ করিবার ভার পড়িয়াছিল এবং স্যার পি, সি, রায় যে বীজ বপন করিয়াছেন, তাহার সুফল অসহযোগীরাই ভোগ করিবে, ভোগ করিবার যোগ্যতাও তাহাদের আছে বটে। স্থানীয় সমস্ত সরকারী কর্মচারীই আমাকে বলিলেন যে, স্বেচ্ছাসেবকেরা গ্রামবাসীদের কৃতজ্ঞতা অর্জন করিয়াছে এবং আগামী নির্বাচনে তাহারা স্বেচ্ছাসেবকদের নির্দেশ পালন করিবে। আমি জনৈক সরকারী কর্মচারীর সঙ্গে একটি ক্ষুদ্র সাহায্য কেন্দ্র দেখিতে গিয়াছিলাম। সেখানে গ্রামবাসীরা স্পষ্টই আমাদিগকে বলিল যে, গান্ধী মহারাজ (এখন আর ‘মহাত্মা গান্ধী’ নহেন, ‘গান্ধী মহারাজ’) এবং তাঁহার শিষ্যগণ গ্রামবাসীদিগকে রক্ষা করিয়াছেন, আগামী নির্বাচনে তাহারা গান্ধী মহারাজের পক্ষে ভোট দিবে। ইউরোপীয় কর্মচারীদের পরিবর্তে তাহারা ভারতীয় কর্মচারীদের চাহে, কেন না তাহারা গান্ধী মহারাজের স্বেচ্ছাসেবকদের মত তাহাদের অভাব অভিযোগ বুঝিতে পারিবে এবং সহানুভূতি প্রকাশ করিবে। তাহারা বলিল যে স্বরাজ যত শীঘ্র সম্ভব আসুক, ইহাই তাহাদের প্রার্থনা, কেন না স্বরাজের আমলে তাহারা সুখী হইবে। আমি আরও দুইদিন গ্রামে কাটাইয়াছিলাম, প্রথম দিন জনৈক অসহযোগী স্বেচ্ছাসেবকের সঙ্গে, দ্বিতীয় দিন জনৈক অভিজ্ঞ ভারতীয় কর্মচারীর সঙ্গে। প্রত্যেক স্থানেই আমি ঐরূপ কথা শুনিতে পাই। গ্রামবাসীদের মনে পূর্বে যদি বা কিছু সংশয় থাকিয়া থাকে, এখন আর তাহা নাই। তাহারা বিশ্বাস করে যে অসহযোগীরাই তাহাদের প্রকৃত বন্ধ, সরকারী কর্মচারীরা নহে। সরকারী কর্মচারীরা নিজেরাও দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করিলেন যে, বাংলার গ্রামে ইহাই এখন প্রচলিত ধারণা।