পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
১৬৫

কাজ করিতেছেন। তাঁহাদের পরিশ্রম কাজের বিস্তৃতির সঙ্গে ক্রমেই বাড়িতেছে। গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া অতিরিক্ত পরিশ্রমে এবং উপযুক্ত আহার্য ও বিশ্রামের অভাবে অনেক কর্মী অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছেন। সাহায্যকেন্দ্রের হাসপাতালে এই সব কর্মীদের চিকিৎসা করা হইয়াছে এবং সুস্থ হইয়াই প্রশংসনীয় সাহসের সহিত তাঁহারা পুনরায় কর্মে যোগ দিয়াছেন।”

 বর্তমানকালে যতদূর স্মরণ হয়, এরূপ ভীষণ বন্যা ইতিপূর্বে আর হয় নাই। ছয় সাত বৎসর পূর্বে ইহার বিবরণ লিপিবদ্ধ হইয়াছে। এই বৎসরের (১৯৩১) সেপ্টেম্বর মাসেও আর একটি প্রবল বন্যা উত্তর ও পূর্ব বঙ্গের বহুলাংশ বিধ্বস্ত করিয়াছে। ইহা ভীষণতা, ধ্বংসের পরিমাণ এবং বিস্তৃতিতে পূর্বের সমস্ত বন্যাকে অতিক্রম করিয়াছে। হিমশিলার মত ইহা সম্মুখে যাহা পাইয়াছে, সমস্তই ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছে।

 অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা ১৯২২ সালের বন্যা সাহায্য কার্যে একজন প্রধান কর্মী ছিলেন। “বাংলার বন্যা ও তাহা নিবারণের উপায়” নামক একটি প্রবন্ধের মুখেবন্ধে তিনি বলিয়াছেন:—

 “কয়েক বৎসর পূর্বে বাংলাদেশে প্রবল বন্যা হইয়া গিয়াছে। গত বৎসরেও আর একটি বন্যা হইয়াছে।

 “সংবাদপত্রের বিবরণে দেখা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদীর গর্ভে প্রায় ২৫ হাজার বর্গ মাইল স্থান গত বৎসর (১৯৩১) ভীষণ বন্যায় বিধ্বস্ত হইয়াছিল। স্মরণীয় কালের মধ্যে এরপ বন্যা এদেশে আর হয় নাই। এই অঞ্চলে লোকবসতির পরিমাণ প্রতি বর্গ মাইলে প্রায় ৮ শত। সতরাং ধরিয়া লওয়া যাইতে পারে যে, বন্যায় প্রায় বিশ লক্ষ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে এবং প্রায় ৪ লক্ষ গৃহ বিধস্ত হইয়াছে। লেখকের বন্যা সম্বন্ধে যে অভিজ্ঞতা আছে (তাঁহার বাড়ী বন্যাপীড়িত অঞ্চলে) এবং সংবাদপত্রে যে বিবরণ বাহির হইয়াছে, তাহা হইতে অনুমান করা যাইতে পারে এই বন্যায় বাংলাদেশের ৮ কোটী হইতে ১০ কোটী টাকা পর্যন্ত ক্ষতি হইয়াছে। বাংলাদেশের প্রত্যেক বাড়ীর মূল্য গড়ে ২০০ শত হইতে ২৫০ শত টাকা ধরিয়া এই হিসাব করা হইতেছে। কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ এর চেয়ে বেশী হইবারই সম্ভাবনা।” (মডার্ণ রিভিউ, ফেব্রুয়ারী, ১৯৩২)।

 আমি পুনর্বার বন্যাপীড়িতদের সাহায্য কার্যের জন্য আহূত হইলাম এবং সঙ্কটত্রাণ সমিতি ঐ কার্যের ভার গ্রহণ করিল। পূর্ব পূর্ব বারের ন্যায় এবারও আমাদের সাহায্যের আবেদনে লোকে সাড়া দিল। কিন্তু ব্যবসাবাণিজ্যে মন্দা এবং অর্থাভাবের জন্য, লোকের সহৃদয়তা সত্ত্বেও পূর্বের মত অর্থ পাওয়া গেল না। আমি আনন্দের সঙ্গে জানাইতেছি যে, খুলনা দর্ভিক্ষ, উত্তরবঙ্গের বন্যা, এবং বর্তমান বন্যা—সকল সময়েই ইউরোপীয় মিশনারীদের নিকট হইতে আমি অর্থসাহায্য ও সহানুভূতি লাভ করিয়াছি। তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ নিজেরা অর্থ সংগ্রহ করিয়া আমাকে দিয়াছেন। কেহ কেহ স্বচক্ষে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করিবার জন্য বন্যাপীড়িত অঞ্চলে গিয়াছেন এবং সংবাদপত্রে তাঁহাদের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করিতে দ্বিধা করেন নাই।

 এবারও বিজ্ঞান কলেজের গৃহে সঙ্কটত্রাণ সমিতির কার্যালয় খোলা হইয়াছিল এবং সৌভাগ্যক্রমে শ্রীযুত সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত, পঞ্চানন বসু, ক্ষিতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত প্রভৃতির মত কর্মীদের সাহায্য আমি পাইয়াছিলাম। ইঁহারা নিজেদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করিয়াও প্রভাত হইতে রাত্রি দ্বিপ্রহর পর্যন্ত কার্য করিতেন। প্রধানতঃ কাঁথি ও তমলুক হইতে আগত একদল স্বেচ্ছাসেবক আমাদের কার্যে বিশেষরূপে সাহায্য করিয়াছিলেন। বন্যার প্রথম অবস্থায় বিধস্ত অঞ্চলে কলেরা ও ম্যালেরিয়ার প্রাদূর্ভাব হইয়াছিল। কিন্তু এইসমস্ত ত্যাগী কর্মীরা “অজ্ঞাত যোদ্ধার” মতই সে সব বিপদ গ্রাহ্য করেন নাই। মানবসেবার