আহ্বানে সাড়া দিয়া স্কুল কলেজের ছাত্রগণ এবং জনসাধারণও অর্থসংগ্রহ কার্যে ব্রতী হইয়াছিলেন। কয়েকমাস পর্যন্ত একটা অপূর্ব দৃশ্য দেখা গিয়াছিল—ছোট ছোট বালক বালিকারা পর্যন্ত বিজ্ঞান কলেজে তাহাদের সংগৃহীত অর্থ দান করিবার জন্য আসিত।
গবর্ণমেণ্ট তাঁহাদের অভ্যাসমত দুর্দশাগ্রস্ত লোকদের কাতর চীৎকারে কর্ণপাত করিলেন না। দৈনিক সংবাদপত্রসমূহের স্তম্ভে বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলের দুঃখদুর্দশার কথা সবিস্তারে প্রকাশিত হইতেছিল। সুতরাং দুর্ভিক্ষ, বন্যা প্রভৃতির প্রতিকারের ভার শাসনপরিষদের যে সদস্যের উপর, তিনি স্পেশাল সেলুন গাড়ীতে এবং ষ্টীমলঞ্চে চড়িয়া বন্যাপীড়িত অঞ্চল দেখিতে গেলেন। কিন্তু সদস্য মহাশয়ের নিজের চোখকাণ রুদ্ধ, অধস্তন কর্মচারীদের চোখকাণ দিয়াই তিনি দেখাশোনা করেন। বিভাগীয় কমিশনার, জেলা ম্যাজিট্রেট, নিজের সিভিলিয়ান সেক্রেটারী ইহারাই তাঁহার বার্তাবহ ও মন্ত্রণাদাতা। দুর্ভাগ্যের বিষয় এবারে মিঃ গাইনের মত সংবাদপত্রের কোন প্রতিনিধি ছিলেন না, যিনি বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলের হুবহু বর্ণনা করিতে পারেন। এই কথা বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, বন্যাপীড়িত অঞ্চলে পূর্ব বৎসর হইতেই দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়াছিল। এই অঞ্চলের প্রধান ফসল পাটের দর কমিয়া যাওয়াতেই দুর্ভিক্ষ আরম্ভ হইয়াছিল।
কিন্তু গবর্ণমেণ্টের জনৈক সদস্য পূর্বেই বলিয়াছিলেন যে, গবর্ণমেণ্ট দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয় এবং দান করিবার অবসর তাঁহাদের নাই। সুতরাং বন্যায় লোকের যে অপরিসীম ক্ষতি হইয়াছিল, তাহা লঘু করিয়া দেখাইবার চেষ্টা করা গবর্ণমেণ্টের পক্ষে স্বাভাবিক। রাজস্ব বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সদস্য তাঁহার ইস্তাহারে বলেন,—
“বর্তমানে কোন দুর্ভিক্ষ নাই, যদিও কিছু সাহায্য করিবার প্রয়োজন আছে। গবর্ণমেণ্ট এবং বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ সকলেই সে সাহায্য করিতেছেন।”
অনাহারের দৃষ্টান্তও তাঁহার চোখে পড়ে নাই!
“সংবাদপত্রের সংবাদদাতারা যে সমস্ত আশঙ্কাজনক বিবরণ প্রেরণ করিয়াছেন, তাহা যে অতিরঞ্জিত, বন্যাপীড়িত স্থানের বর্তমান অবস্থা দেখিয়া তাহা বুঝিতে পারা গেল। যদিও এখনও কতকগুলি লোককে সাহায্য করিবার প্রয়োজন আছে, কিন্তু তাহাদের সংখ্যা বেশী নহে।”
জনৈক ইংরাজ ধর্মযাজক কিন্তু বন্যাপীড়িত অঞ্চলের অবস্থা সম্পর্কে নিম্নলিখিতরূপ বিবৃতি প্রদান করিয়াছেন:—
“ষ্টেটসম্যানের সম্পাদক মহাশয় সমীপেষু (১৯৩১, ২৯শে সেপ্টেম্বর)—
“আপনার ২৩শে সেপ্টেম্বর (১৯৩১) বুধবারের সংখ্যায় বাংলার বন্যার অবস্থা সম্পর্কে যে সরকারী ইস্তাহার প্রকাশিত হইয়াছে, তাহা আমি খুব মনোযোগের সহিত পড়িলাম। ইস্তাহার পড়িয়া বোধ হইল যে রাজস্ব বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সদস্য মহাশয় পাবনা, বগুড়া, এবং রংপুর জেলায় সাতদিন দ্রুতগতিতে ভ্রমণ করিয়াছেন এবং তাঁহার সেই ‘প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা’ হইতে তিনি সরকারী ইস্তাহারে বন্যার বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ প্রতিকারের ব্যবস্থা সম্বন্ধে মতামত প্রকাশ করিতে দ্বিধা বোধ করেন নাই।
“তাঁহার সাহস প্রশংসনীয় হইলেও বিচারবুদ্ধির প্রশংসা করা যায় না। পাবনা জেলা সম্বন্ধে, বিশেষতঃ বেড়া এবং বনওয়ারী নগরের বিল অঞ্চল সম্বন্ধে যে রিপোর্ট দেওয়া হইয়াছে, তাহা ভ্রমাত্মক। আমি এই অঞ্চলে সম্প্রতি তিন সপ্তাহ ভ্রমণ করিয়া আসিয়াছি এবং নিজের সামর্থানুসারে সাহায্য কার্যও করিয়াছি। আমি দেখিয়াছি যে, অনেক স্থলেই, বিশেষতঃ বিল অঞ্চলে ও ইচ্ছামতী ও চিকনাই নদীর নিকটে, আউস ও আমন ধান বন্যায় ডুবিয়া গিয়াছে এবং দরিদ্র গ্রামবাসীরা কাঁচাধান যেটকু পারে রক্ষা করিবার চেষ্টা করিতেছে।