পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৬৮
আত্মচরিত

 আর অধিক দৃষ্টান্ত উল্লেখ না করিয়া আমি শুধু এখানে শ্রীযুত সতীশচন্দ্র দাশ গুপ্তের বর্ণনা উদ্ধৃত করিব। তিনি নিজে বন্যা-বিধ্বস্ত অঞ্চল পরিদর্শন করেন, শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও পদব্রজে ভ্রমণ করিয়া স্বচক্ষে সমস্ত অবস্থা দেখেন।

 “একটি গ্রামে, একটি পরিবার ব্যতীত সমস্ত লোককে আমি কুমুদ ফুলের মূল খাইয়া জীবন ধারণ করিতে দেখিয়াছি। সপ্তাহের পর সপ্তাহ তাহারা অন্ন কাহাকে বলে জানিতে পারে নাই। গ্রামে অনাহারেও লোকের মৃত্যু হইয়াছে। মেয়েরা ছিন্ন বস্ত্র পরিয়াছিল, পুরুষেরা দুর্বল ও নৈরাশ্যগ্রস্ত, বালক বালিকাদের স্বাস্থ্য শোচনীয়। আমি যখন গিয়াছিলাম, দেখিতে পাইলাম যে, কতকগুলি বালক বালিকা কুমুদ ফুলের মূলের সন্ধান করিতেছে। এবং মেয়েরা গৃহে উহাই খাদ্যের জন্য সিদ্ধ করিতেছে। টাঙ্গাইলের বাসাইল থানার অন্তর্গত চাকদা গ্রামের এই অবস্থা। বন্যা বিধ্বস্ত অঞ্চলে এমন শত শত গ্রাম আছে, যাহার অবস্থা এর চেয়ে ভাল নয়। যেখানে কুমুদ ফল হয় না, অথবা যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায় না, সেখানে লোকে কলা পাতার আঁশ খাইয়া জীবন ধারণ করিতেছে।”

 শ্রীযুত ক্ষিতীশচন্দ্র দাশগুপ্তও বন্যাপীড়িত অঞ্চলে লোকের অবস্থা পরিদর্শন করিতে গিয়াছিলেন। তিনি লোকের বাড়ীতে রন্ধনশালার ভিতরে গিয়া, তাহারা কি খাইয়া বাঁচিয়া আছে অনুসন্ধান করিয়া দেখিয়াছিলেন।

 “একটি বাড়ী প্রবেশ করিয়া ঘরের মধ্যে চাহিয়া ক্ষিতীশ বাবু এককোণে দুইখানি ইক্ষুখণ্ড দেখিলেন। গৃহস্বামী ক্ষিতীশ বাবুকে তৎক্ষণাৎ বুঝাইয়া দিলেন যে উহা ইক্ষুখণ্ড নহে, কদলীর ডগা মাত্র। ঐগুলি চাঁচা হইয়াছে, সেজন্য ইক্ষুর মত দেখাইতেছে। সোজা কথায় ওগুলি ‘নকল ইক্ষুদণ্ড’। ছোট ছেলে মেয়েরা যখন কাঁদে এবং তাহাদের খাইতে দিবার কিছু থাকে না, তখন উহা ইক্ষুখণ্ডের মত ছোট ছোট করিয়া কাটিয়া তাহাদের দেওয়া হয়। তাহারা সেগুলি চিবাইয়া রস পান করে। এই ভাবে পরিশ্রান্ত হইয়া পড়ে এবং আর কাঁদে না। শিশুরা চিবাইয়া যে ছোবড়া ফেলিয়া দিয়াছে, তাহাও ক্ষিতীশ বাবুকে দেখানো হইল। ক্ষিতীশ বাবু ঐগুলি লইয়া আসিয়াছিলেন। বিজ্ঞান কলেজে উহা দেখানো হইতেছে।

 “তার পর ক্ষিতীশ বাবু আর একটি বাড়ীতে প্রবেশ করিলেন। সেখানে রান্নাঘরে গিয়া তিনি দেখিলেন যে, দুইটি ছোট ছেলে এক কোণে বসিয়া গোপনে কি যেন খাইতেছে। ক্ষিতীশ বাবু জিনিষটা কি জানিতে চাহিলেন এবং থালাখানা বাহিরে লইয়া আসিলেন। দেখিলেন, ছেলেরা কি একটা আটার মত জিনিষ খাইতেছিল। ছেলেদের বাপ বুঝাইয়া দিল, উহা কচু সিদ্ধ মাত্র। উহার সঙ্গে লবণও ছিল না। বাপ যখন কথা বলিতেছিল, সেই সময় একটা ছয় বৎসরের মেয়ে আসিয়া থালা হইতে তাড়াতাড়ি খাইতে আরম্ভ করিল। ছোট ছেলেদের জন্য খানিকটা রাখিবার জন্য মেয়েটিকে বলা হইল, কিন্তু কথা শেষ হইবার পূর্বেই সে বাকীটকু এক গ্রাসে খাইয়া ফেলিল। ছোট ছেলে দুইটি হতাশ হইয়া কাঁদিতে লাগিল। ওইটুকুই ছিল শেষ সম্বল। বাপ বেচারা রান্না ঘর হইতে পাত্র আনিয়া দেখিল, আর কিছুই অবশিষ্ট নাই।”

 দৈনিক সংবাদ পত্র হইতে উদ্ধৃত ঐ সমস্ত বর্ণনা হইতে বুঝা যায়, দেশের শাসন প্রণালী কি ভাবে চলিতেছে। ঐ সমস্ত বর্ণনাই প্রকৃত অবস্থা জ্ঞাপন করিতেছে, উহার উপর কোনরূপ টীকা নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু তথাপি সাম্রাজ্যবাদের কবি তাঁহার ‘ভারতীর অভিজ্ঞতা’ লইয়া নিম্নোদ্ধৃত অর্থহীন বাজে কবিতা লিখিতে কুণ্ঠিত হন না। ঐগুলি বোধ হয় স্বদেশবাসী এবং বিশ্ববাসীদের মনকে প্রতারিত করিবার জন্য।