পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
১৬৯

শ্বেতাঙ্গের দায়িত্ব ভার মাথায় তুলিয়া লও;[]
দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের অন্ন দাও,
রোগ পীড়া দূর কর;
শ্বেতাঙ্গদের দায়িত্ব ভার মাথায় তুলিয়া লও,
রাজাদের তুচ্ছ শাসনের প্রয়োজন নাই।

(ইংরাজী কবিতার অনুবাদ)

 ১৯২২ সালের উত্তর বঙ্গ বন্যা সম্বন্ধে মন্তব্য প্রকাশ করিতে গিয়া আমি বলিয়াছি,—“প্রজাদের আবেদন গ্রাহ্য করিয়া যদি রেলওয়ের সঙ্কীর্ণ কালভার্টগুলি বড় সেতুতে পরিণত করা হইত, তবে এই বন্যা নিবারণ করা যাইত, অন্ততঃপক্ষে ইহার প্রকোপ বহুল পরিমাণে হ্রাস করা যাইত।” বর্তমান বৎসরের বন্যাও এমন ভীষণ হইত না যদি পূর্ব হইতে সতকর্তা অবলম্বন করিয়া জল নিকাশের পথ করা হইত। সম্প্রতি এই বিষয়ে একখানি সময়োপযোগী পুস্তিকা আমার হস্তগত হইয়াছে। লেখক বিষয়টি খুব যত্ন সহকারে অধ্যয়ন করিয়াছেন, সুতরাং এবিষয়ে তাঁহার কথা বলিবার অধিকার আছে। আমি ঐ পুস্তিকা হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি।

 “১৯২২ সালের উত্তর বঙ্গের প্রবল বন্যা অনেকের চোখ খুলিয়া দিয়াছিল। প্রসিদ্ধ ডাক্তার বেণ্টনী তাঁহার বৈজ্ঞানিক প্রতিভা বলে আবিষ্কার করেন যে ই, বি, রেল পথ (বিশেষতঃ নূতন সারা-সিরাজগঞ্জ রেল পথ) নির্মাণের গরুতর ত্রুটীই ইহার কারণ। এই সমস্ত রেল পথে সঙ্কীর্ণ কালভার্ট এবং ক্ষুদ্র অপরিসর সেতু থাকাতেই জল জমিয়া বন্যার পথ প্রশস্ত করে। এই বন্যারই আনুষঙ্গিক ফল ম্যালেরিয়া, কলেরা, এবং অন্যান্য মারাত্মক ব্যাধির প্রকোপ। কিন্তু এই বন্যা ও মহামারীর ফল ভোগ করে দরিদ্র মূক কৃষককুল, এই আত্মপ্রচার ও বড়মানুষীর যুগে যাহাদের অস্তিত্ব বিসদৃশ বলিয়াই বোধ হয়। সম্প্রতি প্রসিদ্ধ জলশক্তি বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার স্যার উইলিয়াম উইলক্‌স্ যে সব বক্তৃতা করিয়াছেন, তাহার দ্বারা বাঁধ নির্মাণ করিবার নীতির অসারতা প্রমাণিত হইয়াছে। তবু, এই সমস্ত অপকার্য নিবারণ করিবে কে? কত দিনেই বা তাহা নিবারিত হইবে? পক্ষান্তরে, ‘ভবিষ্যৎ বন্যার বিরুদ্ধে সতর্কতার ব্যবস্থা স্বরূপ’ আরও বেশী বাঁধ নির্মিত হওয়া আশ্চর্যের বিষয় নহে।”[]

 উত্তর ও পূর্ব বঙ্গের সাহসী কৃষককুলই গবর্ণমেণ্টের প্রধান সহায় ও শক্তি স্বরূপ, কেননা ইহারাই পাট চাষের দ্বারা ঐশ্বর্য উৎপাদন করে এবং ইহারাই আমদানী ব্রিটিশ বস্ত্রজাত ও অন্যান্য পণ্য দ্রব্যের প্রধান ক্রেতা। গবর্ণমেণ্ট এই দরিদ্র ও অসহায়দের মশা মাছির মত ধ্বংস হইতে দিতেছেন।

 দরিদ্র মূক রায়তেরা যে ক্ষতি সহ্য করিয়াছে, তাহা অপরিমেয়। অনেক স্থলে তাহাদের গোমহিষাদি পশু এবং বাড়ী ঘর বন্যায় ভাসিয়া গিয়াছে। ভারতগবর্ণমেণ্ট সমস্ত পাট শুল্কই নিজেরা গ্রহণ করেন এবং গত কয়েক বৎসরে তাঁহারা প্রায় ৪০।৫০


  1. আমি যখন এই অংশের প্রুফ দেখিতেছিলাম, তখন (১১।৬।৩২) স্যার স্যামুয়েল হোর ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের যে গুণগান করিয়াছেন, তাহা পড়িয়া কৌতুক বোধ করিলাম। প্রত্যুত্তর স্বরূপে আমার বহির এই অংশ তাঁহাকে উপহার দিতে ইচ্ছা হইতেছে। এই আত্মগরিমা কীর্তনের প্রহসন কবে শেষ হইবে?
  2. The Bengal flood, 1931—by Sailendra Nath Banerjee, Member, Board of Directors, Central Co-operative Anti-Malaria Society Ltd., pp. 3-4.